ভ্যান চালিয়ে ৪৫ বছরে ক্যারাটে শেখার ইচ্ছা থেকে হোয়াইট বেল্টের অধিকারী

গৌড় চক্রবর্তী : ‘জানার কোনো শেষ নেই, শেখার কোনো বয়স নেই’ কথাটি যে ১০০% খাঁটি তা আবারও প্রমাণ করে দিলেন বর্ধমান জেলার নবগ্রামের বাসিন্দা উত্তম সাহা। যিনি ৪৫ বছর বয়সী, যে বয়সে অনেকেই নিজেদের বৃদ্ধাবস্থা নিয়ে ভাবতে বসেন, সেই বয়সে ইনার কর্মকাণ্ড দেখলে আপনিও ভাবতে বসবেন। শুধু তাই নয়, তিনি কোনো চাকুরিজীবীও নন, যাতে করে মাসের মাইনে থেকে সখ করে কিছু করার ইচ্ছা জাগে। তিনি পেশায় একজন ভ্যানচালক।

ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়াশুনার পর আর্থিক অনটনে আর পড়াশুনা চালানো হয়ে ওঠেনি। তাছাড়া বাবা মায়ের মৃত্যুতে একদিকে সংসারের হাল ধরা ও অপরদিকে দারিদ্রতা, এককথায় যেন দুদিক থেকেই উত্তমবাবুকে চেপে ধরেছিল, ঠিক যেন মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। বর্তমানে উত্তমবাবুর স্ত্রী এবং দুই ছেলে নিয়ে সংসার । কম পড়াশুনার জন্য চাকরী জোটেনি, আর তাই নিজের সংসারের খরচ জোটাতে ও দুই পুত্রকে খাইয়ে পড়িয়ে মানুষ করতে বন্ধুদের কাছ থেকে কিছু অার্থিক সাহায্য নিয়ে নিজস্ব ভ্যান কিনেছেন বছর খানেক আগে, যা দিয়েই টেনেটুনে সংসার চালানো। পেটের টানে ভ্যান টেনে উখড়া থেকে দক্ষিণখণ্ড পর্যন্ত প্রতিদিন প্রায় সাত আটবার আনাগোনা। কখনও কারো ফার্ণিচার পৌঁছনো, তো কখনও জলের ট্যাঙ্ক, টিন, লোহার রড, সিমেন্ট ইত্যাদি সময় মতো গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া। আর বিনিময়ে কিছু পারিশ্রমিক। কপাল ভাল থাকলে এভাবে সারাদিনে দু তিনশো টাকা পর্যন্ত ইনকাম। মাসে মেরে কেটে সাত থেকে আট হাজার।

এভাবেই প্রতিদিন উখড়া থেকে দক্ষিণখণ্ড রাস্তায় ভ্যান নিয়ে যাবার পথে একদিন উত্তমবাবুর চোখে ধরা পড়ল রাস্তার পাশ্ববর্তী মাঠে কিছু ছেলেকে ক্যারাটে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন, তাঁরই পরিচিত একজন ক্যারাটে শিক্ষক। উত্তমবাবু মনে মনে ভাবলেন, এরকম প্রশিক্ষণ পেলে কেমন হয়? শরীর সতেজ থাকবে পাশাপশি মনোবল চাঙ্গা থাকবে। যেই ভাবা সেই কাজ। রাস্তার পাশে ভ্যান দাঁড় করিয়ে সরাসরি কথা বললেন শিক্ষকের সাথে। ছাত্রের বয়স ৪৫ তো কি হয়েছে? এমন মনোযোগী ছাত্র পেয়ে শিক্ষকও রাজি হয়ে গেলেন। সেই থেকে শুরু হল উখড়া ক্যারাটে একাডেমিতে তাঁর ক্যারাটে প্রশিক্ষণ। সপ্তাহে বুধবার, শুক্রবার এবং শনিবার সকালে ঘন্টা তিনেকের ক্লাস। ক্লাসের সময় হলেই নিজের ভ্যান চালিয়ে উত্তমবাবু হাজির। দু একটি ভাড়া হয়তো তাতে হাত ছাড়া হয়ে যায়, তাতে ক্ষতি কি? ‘জানার কোনো শেষ নেই, শেখার কোনো বয়স নেই’, এমনই অভিমত উত্তমবাবুর।

তাঁর এমন শেখার জেদ এবং অধ্যাবসায় দেখে কার্যত হতবাক অন্যান্য শিশুর অভিভাবকেরাও। ভ্যান চালিয়ে টাকা জোগাড় করে কোনোক্রমে সংসার চালানো, ছেলেদের আবদার মেটানো, আবার তারপর খরচ বাঁচিয়ে এখানে প্রশিক্ষণ। এভাবেই দেখতে দেখতে আট মাস হল উত্তমবাবুর প্রশিক্ষণ পর্ব। বর্তমানে হোয়াইট বেল্টের অধিকারী তিনি। ভবিষ্যতে আরও এগিয়ে যেতে চান। শেষ করতে চান ক্যারাটে প্রশিক্ষণের প্রতিটি পর্যায়। যেখানে বয়স কিম্বা আর্থিক অনটন কোনো বাধায় হয়ে দাঁড়াতে পারে না, জানালেন উত্তমবাবু।

বর্তমান প্রজন্মের শিশু থেকে কিশোরদের মধ্যে যেখানে হারাতে বসেছে শরীরচর্চা, যোগ কিম্বা ক্যারাটের মতো স্বাস্থ্যকেন্দ্রিক প্রশিক্ষণ, যেখানে সমগ্র জগৎ মুঠো ফোনে আষ্টেপৃষ্ঠে আবদ্ধ, সেখানে উত্তমবাবু যে আমাদের সকলের প্রেরণা তা এককথায় বলাবাহুল্য।