গোড়া থেকে ২০২০, ইতিহাসের পাতায় অযোধ্যায় রাম মন্দিরের প্রতিষ্ঠা

নিজস্ব প্রতিবেদন : বাবরি মসজিদের স্থাপনাকাল ১৫২৮-২৯ (৯৩৫AH) সালে। চিতরের রানা সংগ্ৰামকে পরাজিত করে হিন্দুস্থানে সম্পূর্ণ অধিকার স্থাপনের পর বাবরের সেনাপতি মীর বাকি বাবারের ইচ্ছায় অযোধ্যার রামকট দূর্গে এই মসজিদ স্থাপন করেন।‌ আশ্চর্যজনক ভাবে সমকালীন ‘বাবরনামা’ যা বাবরের বোন লেখেন এবং আবুল ফজলের ‘আইন ই আকবরীতে’ (১৫৯৮) বাবরি মসজিদের কোন উল্লেখ নেয়। উল্লেখ নেয় তুলসি দাসের রাম চরিতমানসেও (১৫৭৮)। ১৯৪০ পর্যন্ত এর নাম ‘বাবরি মসজিদ’ ছিল না, ছিল মসজিদ-ই-জন্মস্থান!

ইংরেজ ভূপর্যটক উইলিয়াম ফিনচ ১৬১১ সালে অযোধ্যায় আসেন। তিনি লেখেন, “Ruins of ranichand (Ramchand) castle houses where God took fleshes upon him to see the tamasha of the world.” রামচাঁদের দুর্গের ধ্বংসাবশেষে ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা পুজো দেন। তীর্থযাত্রীরা আসে। কিন্ত বাবরি মসজিদের উল্লেখ করেননি। ১৬৩২ সালে থমাস হার্বাট বহু পুরাতন রামচাঁদ দূর্গের উল্লেখ করেন। বলেন এর অসাধারণ স্থাপত্য শৈলীর কথা। তিনিও উল্লেখ করেন পুজো ও তীর্থযাত্রীর কথা।

বাবরি মসজিদের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় জয়পুরের মহারাজা দ্বিতীয় জয় সিংহের সময় ১৭১৭ সালে। যখন অযোধ্যার এই এলাকা মোগল দরবারের কাছ থেকে কিনে নেন। জেসুইট মিশনারি যোশেফ তিফেনথালের জানান (১৭৪৩-১৭৮৫) ওরঙ্গজেব রামকোট দূর্গ ধ্বংস করে মসজিদ নির্মাণ করেন। কেউ কেউ বাবর মসজিদও বলে।

১৮৭৭ সালে প্রথম সৈয়দ মহম্মদ আসগর ফৈজাবাদের কমিশনারের কাছে অভিযোগ করেন হিন্দুরা রামের জন্মস্থান বলে বাবরি মসজিদের চাতালে পুজো শুরু করেছে। তা বন্ধ করতে হবে। ডিস্ট্রিক জাজ ও সাব জাজ তদন্ত করতে গিয়ে দেখেন ওখানে শুধু আল্লা লেখা ছিল। ১৮৮৯ ওই একই জায়গায় তিনটে লিখিত পাথর পাওয়া যায় যেখানে বাবরের উল্লেখ পাওয়া যায়। যা আগে ছিল না। বাহাদুর শাহ ১ এর কন্যার (আওরঙ্গজেবের নাতনি) লিখিত বইয়ে (Sahifa-i-chihil Nasaih Bahadur Saha (১৭০৬-১২) স্পষ্ট উল্লেখ আছে, মথুরা, বেনারস ও অযোধ্যার মন্দির ভেঙ্গে মসজিদ নির্মাণ হয়।

১৮৫৩ সালে নির্মোহী আখরার সদস্যরা প্রথম রামজন্মভূমীর এলাকা দখল করে। দুই বছর ধরে হিন্দু মুসলমানের সাথে চলে ঝামেলা। ইংরেজ সরকার মন্দির বানানো নিষিদ্ধ করে দেয়। এলাকাকে ঘিরে দুই ভাগ করে দেওয়া হয় হিন্দু মুসলমানের মধ্যে প্রার্থনার জন্য। ১৮৮৩ সালে হিন্দুরা আবার মন্দির নির্মাণের চেষ্টা করে। ১৮৮৫ মাহান্ত রঘুবীর দাস সিভিল সুট ফাইল করেন কিন্তু তা বাতিল হয়ে যায়। ১৯৪৯ সালে অখিল ভারতীয় রামায়ন মহাসভা ৯ দিন ধরে রাম জন্মভূমিতে প্রার্থনা শুরু করে এবং বাবরি মসজিদের ভিতর রাম সীতার মূর্তী স্থাপন করে দেন। জহরলাল নেহেরু ও বল্লভাই প্যাটেল ইউপির মুখ্যমন্ত্রী গোবিন্দ পন্থকে মূর্তী সরানোর নির্দেশ দেন। ১৯৫৯ সালে নির্মোহী আখরা রামজন্মভূমী অধিকার পাবার জন্য নতুন করে ল-সুট ফাইল করে। ১৯৮৬ সালে মন্দিরের দরজা খুলে দেওয়ার দাবি উঠলে বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটি গড়ে ওঠে।

১৯৮৯ সালে রামজন্মভূমিতে পুজো চালু রাখার নির্দেশ দেয় আদালত। এরপরই রাজীব গান্ধীর কংগ্ৰেস সরকার ভিএইচপিকে রাম মন্দিরের সিলোন্যাস করার অনুমতি দেয়। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়। ১৯৯৩ সালে বিশেষ অধিগ্ৰহন জমি অ্যাক্ট পাস করা হয়। ১৯৯৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় ইসলাম ধর্ম পালনের জন্য মসজিদ জরুরি নয়। রাষ্ট্রের জমি অধিগ্রহণ সংবিধান বিরোধী।

২০০২-২০০৫ এলাহাবাদে শুনানি শুরু হয়। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়াকে ভার দেওয়া হয় ঘরে মন্দির ছিল কিনা তা খুঁজে দেখা। তারা জানান খনন করে সেখানে মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছে। মসজিদ কর্তৃপক্ষ একে মিথ্যা বলে। ২০০৯ সালে মনমোহন সিংহের কাছে রিপোর্ট পেশ করে লিবেরহান কমিশন। ২০১০ সালে বিতর্কিত জমিকে ৩ ভাগ করে এলাহাবাদ হাইকোর্ট।সুন্নী ওয়াকফ বোর্ড, নির্মোহী আখড়া ও রামলাল্লার দলকে দেওয়া হয়। হাইকোর্টের এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে অখিল ভারতীয় হিন্দী মহাসভা ও ওয়াকফ বোর্ড। ২০১১ সালে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে সুপ্রিম কোর্ট। ২০১৬ সালে বিজেপির মন্ত্রী সুব্রহ্মণ্যন স্বামী বিতর্কিত জমিতে রামমন্দির নির্মাণের দাবি করলেন।

২০১৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি রঞ্জন গগৈ ৫ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ গঠন করেন। তৈরি হয় মধ্যস্থতাকারী প্যানেল। তা ব্যর্থ হলে ৬ আগস্ট থেকে দৈনিক শুনানি শুরু হয়।

২০১৯ সালে ৯ই নভেম্বর রাম জন্মভূমীর রায় দেয় সুপ্রিম কোর্ট। হিন্দুরা তাদের জমিতে মন্দির বানাতে পারবে। আর মসজিদ তৈরির জন্য ৫ একর জমি দেওয়া হবে। ২০২০ সালে ৫ই আগস্ট রাম মন্দির নির্মাণের জন্য হল ভূমি পূজো।