তর্পণের অর্থ, তর্পণের আগে জানুন গুরুত্বপূর্ণ ৮টি বিধিনিষেধ

নিজস্ব প্রতিবেদন : প্রাচীনকালে পুত্রের জন্মের জন্য পুরুষ মানুষেরা একের অধিক বিয়ে করতেন। সেই সময় পুত্রের জন্মের জন্য এতটা জোর‌ প্রয়োগ করা হতো তর্পণের উদ্দেশ্যে। বংশের যে সকল‌ পিতৃ পুরুষ পরলোক গমন করেছেন, তাদের উদ্দেশ্যে স-তিল জল দান করাকে তর্পণ বলা হয়।

মৃত পিতৃপুরুষ ও মাতামহকুলের গোত্র সম্বন্ধ ও নাম উল্লেখ করে একটি মন্ত্রে তিন অঞ্জলি জলদান পূর্বক তর্পণ করতে হয়। পিতৃকুল ও মাতামহকুলের মধ্যে কেউ জীবিত থাকলে তার নাম বাদ দিয়েই তর্পণ করতে হয়। বলা হয় তিল সহ এই জল পিতৃপুরুষ ও মাতৃ পুরুষের উদ্দেশ্যে দান করলে মৃত্যুর পর পিতৃ ও মাতৃকুল স্বর্গে গিয়েও জল অন্ন পান, আর যেহেতু স্ত্রীলোকের তর্পনের নিষেধ আছে, তাই কন্যা সন্তান এই তর্পনের অধিকার থেকে বঞ্চিত। এই কারণেই বলা হতো পুত্রসন্তান থাকলেই পিতৃপুরুষেরা জল পাবেন।

তর্পন কথাটি এসেছে ত্রুপ (অর্থাৎ সন্তুষ্ট করা) থেকে। দেবতা, ঋষি ও পূর্বপুরুষদের (পিতৃকুল ও মাতৃকুল) আত্মার উদ্দেশ্যে জল নিবেদন করে তাদের সন্তুষ্ট করার পদ্ধতিকে তর্পণ বলা হয়।

শাস্ত্রে বলা হয় প্রতিটি মানুষের দিনে একবার তর্পন করা উচিত। যে ব্যক্তির পিতা জীবিত আছেন সেই ব্যক্তির সাধারণ তর্পণ করা নিষেধ, এছাড়া স্ত্রীলোকেরও তর্পনে নিষেধ আছে। তবে যে বিধবার পুত্র পৌত্রাদি নেই, তিনি স্বামী, শ্বশুর ও শ্বশুরের পিতার উদ্দেশ্যে তর্পণ করতে পারেন।

তর্পণের ক্ষেত্রে সব সময় তিল সহ জল অর্পণ করা যায় না। এক্ষেত্রে কিছু নিয়ম আছে।

১) রবি ও শুক্রবারে, সপ্তমী ও দ্বাদশীতে, শ্রাদ্ধ দিনে ও জন্ম দিনে তিলসহ তর্পণ নিষিদ্ধ।

২) অমাবস্যা শ্রাদ্ধে, সংক্রান্তিতে, গ্রহণকালে, গঙ্গা প্রভৃতি তীর্থে, বৃষোৎসর্গে, যুগাদ্যায়, মৃতাহে ও প্রেত পক্ষে নিষিদ্ধ দিনেও তিল তর্পণ করা যায়।

৩) পিতা জীবিত যাদের, তারা কেবল প্রেততর্পণ করতে পারবেন। সাধারণ তর্পণ করা তাদের নিষেধ।

৪) শ্বেত চন্দন জলে মিশিয়ে তর্পণ করলে তা বিশেষ ফলপ্রদ হয়।

৫) ব্রাহ্মণ শূদ্র সকলেরই তর্পনের সমান অধিকার।

৬) সকাল-সন্ধ্যা দুইবেলাতেই পুজোর পরে তর্পণ করা যায়। তবে দুই বেলা না পারলেও অন্তত পক্ষে এক বেলা তর্পণ করা।

৭) কাল অশৌচে প্রেত তর্পণ ছাড়া অন্য কোন তর্পণ করা যায় না।

৮) পিতৃ ও মাতৃ তর্পণের ক্ষেত্রেই খালি তিল অর্পণ করা যায়। দেব তর্পন, ঋষি তর্পণ ও মনুষ্য তর্পণের ক্ষেত্রে তিলের ব্যবহার নিষেধ। এই সকল ক্ষেত্রে যব ব্যবহার করতে পারা যায়।

দেব তর্পণ, মনুষ্য তর্পন, ঋষি তর্পণ, দিব্য পিতৃ তর্পন, যম তর্পণ, ভীষ্ম তর্পণ, পিতৃ তর্পণ, মাতৃ তর্পণ, অগ্নিদগ্ধাদি তর্পন, রাম তর্পন ও লক্ষণ তর্পন ইত্যাদি প্রকার আছে।

তর্পণ কেন করা আবশ্যক?

তর্পন করলে পিতৃ ও মাতৃ কুল মৃত্যুর পর ও জল পান। এই কারণে তারা সন্তুষ্টি বোধ করেন। তাদের আত্মার সন্তুষ্টি হলে আমাদের জীবনে সুখ-শান্তি নেমে আসে। এছাড়া জীবন ধারণ করার জন্য আমাদের অনিচ্ছাসত্ত্বেও প্রাণী হিংসা করে জীবন ধারন করতে হয়, শাস্ত্রে বলা হয় তর্পণের দ্বারা এই সকল পাপের থেকে মুক্ত হওয়া যায়। তর্পনের মন্ত্রের অর্থ হলো সকলের মঙ্গল কামনা। ব্রহ্মা থেকে শুরু করে তৃণ খন্ড পর্যন্ত সমস্ত জীবজগৎ জলের ধারা তৃপ্ত হোক এই প্রার্থনাই করা হয় তর্পনের মন্ত্রে।তর্পন সম্বন্ধীয় একটি ঘটনার উল্লেখ আছে পৌরাণিক শাস্ত্রে। এটি মহাভারতের মহাবীর দাতা কর্ণ সম্বন্ধীয়।

কর্ণ চিরকাল স্বর্ণ রত্ন ইত্যাদি দান করে গেছেন, তিনি পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্য কখনো জল বা খাদ্য দান করেন নি। কারণ তিনি নিজের পিতৃ পুরুষের পরিচয় সম্পর্কেই জানতেন না। এই ভুল ছিল তার সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত। তবু এই ভুলের জন্য মৃত্যুর পর তাঁর আত্মা যখন স্বর্গে অবস্থান করছিল তখন তাকে খাদ্যদ্রব্য হিসেবে স্বর্ণ ও রত্ন দেওয়া হয়। কর্ণ এর কারণ জানতে চাইলে দেবরাজ ইন্দ্র তাকে তর্পণ না করার কথা বলেন। কর্ণ তখন ইন্দ্রদেবকে বলেন, যুদ্ধের আগের রাতেই তিনি পিতা ও পিতৃ পুরুষদের সম্বন্ধে জেনেছিলেন। তার আগে অবধি তিনি নিজের বংশ পরিচয় জানতেন না। এটি তার অনিচ্ছাকৃত ভুল।

ইন্দ্র তখন অনিচ্ছাকৃত ভুল সংশোধনের জন্য তাকে ষোলো দিনের জন্য মর্তে পাঠান। আর মর্তে গিয়ে কর্ণ পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্যে জল ও অন্ন দান করে আসেন এই সময়টিকেই পিতৃপক্ষ বলা হয়।

এই বছর পিতৃপক্ষের অবসান তথা তর্পনের দিনক্ষণ

এই বছর ১৭ই সেপ্টেম্বর পিতৃপক্ষ শেষ। সেই অর্থে পিতৃপক্ষে তর্পন করতে চাইলে এই দিন বা এই দিনের আগেই তর্পন করতে হবে‌। ১৬ সেপ্টেম্বর রাত ৭ টা ৫৮ মিনিটে অমাবস্যার শুরু আর ১৭ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে চারটেই অমাবস্যা শেষ। তাই এই সময়ের মধ্যেই তর্পন করতে হবে।

তর্পনের জন্য মহালয়ার দিন বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। রামায়নে বলা হয় মহালয়ার দিন রামচন্দ্র পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পন দিয়েছিলেন। এটি পিতৃপক্ষের সময়। এই সময় পূর্বপুরুষদের আত্মা পৃথিবীর খুব কাছে বিরাজ করেন। পিতৃপক্ষে শুভ কার্য অনুষ্ঠিত হয় না, এই সময় শ্রাদ্ধ তর্পণ ইত্যাদি মৃত্যু সংক্রান্ত আচার অনুষ্ঠান করা হয়।

গণেশ পুজোর পরের ভাদ্র পূর্ণিমা তিথি থেকে পিতৃপক্ষের সূচনা। শাস্ত্রে বলা হয় এইসময় তর্পণ করলে তর্পনের উদ্দেশ্য সফল হয়। এছাড়া পিতৃপক্ষে তর্পণ করা বিশেষ ফলপ্রদ। এই সময় যদি কেউ তর্পণ করতে না পারেন তাহলে তার অমাবস্যায় তর্পণ করা উচিত।