কোন সাপের বিষ আছে, কার বিষ নেই? কামড়ালে কি করবেন, কি করবেন না, জানুন খুঁটিনাটি

নিজস্ব প্রতিবেদন : সাপ নিয়ে আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে রয়েছে ব্যাপক আতঙ্ক। মানুষের আতঙ্কিত হওয়ার কারণ আমাদের ভারতবর্ষে প্রতিবছর প্রায় ৫০০০০ মানুষ মারা যান সাপের কামড়ে, আবার বেসরকারি মতে এই সংখ্যাটা প্রায় এক লক্ষ। পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যাটা প্রায় ৫ থেকে ৬ হাজার অথচ অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ, যেখানে বিষধর সাপের সংখ্যা অনেক বেশি, সেখানে সাপের কামড়ে মৃত্যুর হার পাঁচ বছরে দুই থেকে তিনজন। কিন্তু কেন?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমরা শরণাপন্ন হয়ে ছিলাম জাতীয় বন্যপ্রাণ অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ব্যুরোর সদস্য দীনবন্ধু বিশ্বাস মহাশয়ের। আর তাঁর দেওয়া উত্তরেই এই সমস্ত প্রশ্নের সমাধান সূত্র বেরিয়ে আসে।

দীনবন্ধু বিশ্বাস মহাশয় প্রথমেই জানান, “সাপের কামড়ে এরা মারা যায় না, সাপের কামড়ের ওঝা গুনিনের কাছে যাওয়ার জন্য মারা যায় এরা।”

দীনবন্ধু বিশ্বাস মহাশয় মূলত বীরভূমের মত মফস্বল এলাকায় সাপ এবং বন্যপ্রাণী অপরাধ নিয়ন্ত্রণের কাজে যুক্ত। সেইমতো তিনি জানান, তার এই কর্ম সময়ের ২০ বছরে বীরভূমে মাত্র ২৩ রকমের প্রজাতির সাপ দেখেছেন। যার মধ্যে পাঁচ রকমের সাপ রয়েছে যারা বিষধর, ৪টি ক্ষীণবিষ এবং ১৪ ধরনের সাপ নির্বিষ। বিষধর সাপ গুলির মধ্যে আবার একটি সাপ কামড়ায় না, যেটি হল শাঁখামুটি বা রাজসাপ। তাহলে বাকি যে ৪ টি বিষধর সাপ রয়েছে সেগুলি কামড়ালে মানুষের মৃত্যু হবে, যদি সেই ব্যক্তি হাসপাতালে চিকিৎসা না করান।

বিষাক্ত সাপগুলি হলো -১) গোখরো (ফণাধর নার্ভবিষ) – গোখরো সাপ কে আঞ্চলিক ভাষায় অনেকে খরিশ বলে থাকেন। সাপ চেনার উপায় হলো ফোন আর পিছনে U আকারের চিহ্ন থাকে, গায়ের রং গমের মতো। সেই রঙ কখনো কখনো গাঢ় বা হালকা হয়।

২) কেউটে (ফণাধর নার্ভবিষ) – এদের ফণার পিছনে গোলাকার চিহ্ন থাকে। গায়ের রং কাল অথবা গাঢ় বাদামি।

৩) চন্দ্রবোড়া (রক্ত কনিকা ধ্বংশকারী) – মাথা তিনকোনা, গোটা গায়ে চাঁদের মত তিন সারি দাগ থাকে। পেশার কুকারের সিটির মতো এই সাপটি প্রচন্ড আওয়াজ করতে পারে।

৪) কালাচ (ফণাহীন নার্ভ বিষ) – সম্ভবত এরা এশিয়ার মধ্যে তীব্র বিষধর সাপ। গায়ের রং কালো, মাথার পিছন থেকে খানিকটা দূরে দুটো দুটো করে সাদা দাগ থাকে লেজ পর্যন্ত। জিভ লাল রঙের হয়।

গোখরো, কেউটে এবং ডোমনা চিতি বা কালাচ এই তিনটি সাপের বিষ নিউরোটক্সিক। যেখানে কামড়াবে সেই জায়গাটি ফুলে যাবে, যন্ত্রণা হবে, হাত পা অসাড় হয়ে আসবে, ঘুম পাবে, ঝিমুনি হবে, মুখ থেকে লালা পড়বে, শ্বাসকষ্ট হবে, সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে শেষকালে হৃদপিন্ডের কাজ বন্ধ হয়ে মারা যাবে।

চন্দ্রবোড়ার বিষ হিমোটক্সিস। এই বিষ রক্ত এবং কলাকোষকে ধ্বংস করে। এখানে কামড়ায় সেই জায়গা ভীষণভাবে ফুলে যায়, এই বিষের জ্বালা অনেকটা পোড়ার মতো। নাক, কান, মুখ এরকম শরীরের প্রতিটি ছিদ্র দিয়ে রক্ত বের হতে শুরু করে। এমনকি শেষের দিকে প্রস্রাবের সাথে রক্ত বের হতে শুরু করে, কিডনি কাজ করা বন্ধ করে দেয়।

এবার প্রশ্ন হল সাপে কামড়ালে কি করবেন না? এ প্রসঙ্গে দীনবন্ধু বিশ্বাস মহাশয় জানান, “আতঙ্কিত হয়ে পড়বেন না যাতে করে রোগী আরো চঞ্চল হয়ে ওঠে এবং হৃদপিন্ডের হৃদগতি বেড়ে যায়, বিষ আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। রোগীকে ওঝা, গুণিনের কাছে নিয়ে যাবেন না, বাঁধন দেবেন না (আধুনিক চিকিৎসায় বারণ), ক্ষতস্থানে কাটাছেঁড়া করা যাবে না, মুখ দিয়ে চুষে বিশ্বের করার চেষ্টা করবেন না, ঠান্ডা বা গরম কোনরকম সেক দেওয়া যাবে না, মাদকদ্রব্য বা ধুমপান করানো যাবে না, রোগীকে হাঁটাচলা করতে দেওয়া যাবে না।”

সাপে কামড়ালে কি করবেন সে বিষয়ে তিনি জানান, “প্রথমেই রোগীকে সান্ত্বনা দিন, তোমাকে সাপে কামড়েছে ভয়ের কোন কারণ নেই, হাসপাতালে নিয়ে গেলে তুমি ঠিক হয়ে যাবে। তারপর দ্রুত ওই রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যান। রোগীকে নিয়ে যাওয়ার সময় তার সাথে কথা বলতে বলতে নিয়ে যান যাতে করে সে ঘুমিয়ে না পরে। মুখ দিয়ে লালা পরলে লালা পরিষ্কার করে দিন, শ্বাসকষ্ট হলে বুকে আলতো চাপ দেবেন। খুব যদি শ্বাসকষ্ট হয় তাহলে রোগীর মুখে মুখ দিয়ে কৃত্রিমভাবে শ্বাস-প্রশ্বাসটা চালু রাখবেন। ডাক্তারকে গিয়ে সব সত্যি কথা বলবেন, আবেগে বেশি বা কম বলবেন না।”