করোনা আবহে আঠারোর স্মৃতি চিনপাই সিদ্ধেশ্বরী কালী পুজোয়

গৌর চক্রবর্তী : করোনা আবহ কেড়ে নিয়েছে এবছর আনন্দোৎসবের সব আনন্দটুকু, সে গণেশ চতুর্থী, বিশ্বকর্মা পুজো কিংবা শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপূজা। সবেতেই করোনা সংক্রমণের চোখ রাঙ্গানি পুজোর তাল কেটেছে। বাদ যায়নি কালীপুজোও।

আদালতের নির্দেশে এবছর কালীপুজোয় বেশকিছু রদবদল করতে হচ্ছে। বন্ধ রাখতে হচ্ছে সমস্ত রকমের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ফলস্বরূপ, ফিকে হতে চলেছে পুজোর যাবতীয় আনন্দ উল্লাস। আর এসবেরই যাঁতাকলে পড়ে যেন আঠারোর স্মৃতি ফিরে পাচ্ছে চিনপাইবাসী।

সদাইপুরের চিনপাই গ্রামের কালীপুজো বীরভূমের যে কয়েকটি হাতেগোনা পুজো রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম। এখানে দুর্গাপুজোর তুলনায় ঢের জাঁকজমক কিংবা আনন্দ উল্লাস সবকিছুই কালীপুজোকে ঘিরে। এখানে সুপ্রাচীন দুটি সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির রয়েছে। গ্রামবাসীর কাছে যা বড়মা এবং ছোটমা নামেই পূজিত। পুজো দুটি এক সময় পারিবারিক হলেও বর্তমানে তা সার্বজনীন।

কথিত আছে, এই দুই মা খুবই জাগ্রত। এই দুই মায়ের পুজোকে ঘিরে গ্রামে প্রত্যেকটি বাড়িতে নিকটাত্মীয়ের আগমনে ও বাচ্চাদের কোলাহলে পরিপূর্ণ হয়ে থাকে। প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই নিকট আত্মীয় স্বজনের আসা-যাওয়া, দীপাবলি উদযাপন, চারিদিকে আলোর রোশনাই যেন গ্রামের পরিবেশকে নিয়ে যায় অন্য কোন এক মায়াবী জগতে।

তবে সেই ছবি আর নেই এবছরের কালীপুজোয়। যেমন, মায়ের বারি আনার মুহূর্তে আতশবাজির প্রদর্শনী প্রচুর পর্যটকের কাছে বেশ আকর্ষণীয়। এছাড়া পুজোর রাত্রি শেষে মায়ের মালশা প্রসাদ নেবার জন্য দূরদূরান্ত থেকে ভক্ত সমাগম ঘটে। আবার গ্রামের মহিলাদের দ্বারা মঞ্চস্থ নাটক কিংবা যাত্রাপালা পুজোর আনন্দে এক অন্যমাত্রা আনে। সবশেষে বিসর্জনের দিন মহা উদ্দীপনায় মায়ের বিশ্রাম তলা প্রাঙ্গণে হাজার হাজার মানুষের মধ্যে খিচুড়ি প্রসাদ বিতরণ করা হয়ে থাকে। দিন দিন মায়ের পুজোর জৌলুস এবং ভক্ত সমাগম যেন বেড়েই চলেছে।

শুধু জেলা বা রাজ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, চিনপাই সিদ্ধেশ্বরী মায়ের পুজোর প্রাচুর্য যেন সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
তবে করোনা ভাইরাসের জেরে এবছর পুজোর সেই জাঁকজমক কিংবা জৌলুস অনেকখানি ফিকে করে দিয়েছে। প্রশাসন থেকে বাতিল করা হয়েছে সমস্ত রকমের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মেলা থেকে প্রসাদ বিতরণ। আর প্রশাসনের এই নির্দেশেই যেন আঠারোর স্মৃতি ঘোরাফেরা করছে চিনপাই গ্রামবাসীর মনে। সে বছর যেরকম পূজার পরের দিন খোওয়া গেছিল মায়ের সমস্ত অলংকার। দুইবছর আগে সেদিন এক লহমায় দুষ্কৃতীরা পুজোর সব আনন্দটুকু কেড়ে নিয়েছিল। আনন্দ উল্লাসকে বিসর্জন দিয়ে অশ্রুসজল চোখে বিচার চেয়ে গ্রামবাসীরা পথ অবরোধ করেছিল। তারপরে সে বছর আর বাজেনি কোন বাদ্যযন্ত্র কিংবা জ্বলেনি দীপাবলির আলো। বাতিল করা হয়েছিল সমস্ত রকমের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ফিকে হয়ে গেছিল পুজোর সব আনন্দ। আর সেদিনের সেই দুঃখের স্মৃতি যেন মিলে যাচ্ছে আজকে বর্তমান পরিস্থিতির সাথে। পুজো আছে কিন্তু নেই সেই জাঁকজমকতা। আনন্দ আছে কিন্তু পরিপূর্ণতা নেই। সে বছর দুষ্কৃতীরা নিয়ে গেছিলো সবকিছু। আর আজ করোনা কেড়ে নিয়েছে আনন্দের মুহূর্ত।

এসবের পরেও পুজোর উদ্যোক্তা শিবনাথ বাগদি কৃষ্ণেন্দু চ্যাটার্জী ব্যস্ত প্রশাসনের নির্দেশমতো পূজো পরিচালনা করতে। তবুও যেন তাদের মনের মধ্যে উঁকি দিচ্ছে যে কবে কাটবে আতঙ্কের এই ঘন মেঘ? কবে তাদের সন্তানরা আতশবাজি পুড়িয়ে মহা ধুমধাম করে তারা তাদের মাকে আবার বরণ করবে?