প্রণব মুখার্জির রাজনৈতিক জীবনের বিতর্কিত ৪টি অধ্যায়

নিজস্ব প্রতিবেদন : স্বাধীনতা পরবর্তী ভারত মুখোমুখি হয়েছে একের পর এক কঠিন সমস্যার। কখনো বিপদের মুখে পড়েছে ভারতীয় গণতন্ত্র, কখনো বিপন্ন হয়েছে খালিস্থানকে নিয়ে ভারতের অখন্ডতা, কখনো ইন্দিরা গান্ধীর প্রশয়ে সঞ্জয় গান্ধীর স্বৈরাচার বিপদের মুখে ফেলে দিয়েছে ভারতকে। এই সমস্ত ঘটনার সঙ্গে জড়িয়েছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। ভারতীয় রাজনীতিতে এইসব ঘটনায় প্রণব মুখার্জির ভূমিকা বিতর্কের উর্দ্ধে নয়। কিন্তু এই সব বিতর্কিত ঘটনা নিয়ে নানান সময়ে মুখ খুলেছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। লিখেছেন এই বিতর্কিত ঘটনা নিয়ে অসামান্য জীবনের দলিল। ‘The coalition years’, ‘The Turbulent years’, ‘The Dramatic decade’।

বিতর্কিত অধ্যায়ের ব্যাখ্যা –

১. The Dramatic years (জরুরি অবস্থার সময়) : ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা জারি করেন দেশ জুড়ে। যাতে দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। সংবাদপত্রের ওপর সেন্সর করা হয়। বিরোধী পক্ষকে জেলে ভরা হয়। শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বার্থে। বিতর্কিত এই সিদ্ধান্তে ভালো কিছু দিক থাকলেও ভারতীয় গণতন্ত্র এর ফলে বিপদের মধ্যে পড়ে। প্রণব মুখার্জি পরবর্তী ক্ষেত্রে স্বীকার করেছেন, এই জরুরি অবস্থা জারি না করলেই ভালো হতো। কারণ এর জন্য কংগ্ৰেস ও ইন্দিরা গান্ধীকে মূল্য চোকাতে হয়।

২. অপারেশন ব্লু-স্টার : ১৯৮০ এর দশকে অপারেশন ব্লু-স্টার ভারতের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। প্রণব মুখার্জি এইসময় ইন্দিরা গান্ধীর ক্যাবিনেট মন্ত্রি ছিলেন। প্রণব মুখার্জি স্বর্ণ মন্দিরে মিলিটারি অপারেশনের বার বার সমর্থন জানিয়েছেন। তাঁর মত ছিল সন্ত্রা’সবাদীদের স্বর্ণ মন্দির থেকে সরাতে আর কোন উপায় ছিল না। যদিও এই সিদ্ধান্ত বারবার সমালোচিত হয়েছে। প্রণব মুখার্জি জানিয়েছেন, ইন্দিরা গান্ধী তাকে বলেছিলেন, এই মিলিটারি অপারেশনের ফলাফল সম্বন্ধে। এতে তাঁর জীবনে বিপদে আশঙ্কা আছে। কিন্তু দেশের স্বার্থে এই সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ করতে হবে।

যদিও খলিস্থান পন্থীদের অনেক আগেই থামানো সম্ভব ছিল বলে সমালোচকদের মত। সমালোচকদের এই মতকে সমর্থন করেননি প্রণব মুখার্জি। তিনি বলেন, তাঁরা জানতেন না তখন কোন পথে এই সমস্যা সমাধান হতো। পরিস্থিতি অনুযায়ী এই সিদ্বান্ত নিতে হয়েছিল। পঞ্জাবের অবস্থা ছিল অস্বাভাবিক। হ’ত্যা ও ধর্মীয় স্থানকে সন্ত্রা’সবাদীদের থামাতে মিলিটারি অপারেশন ছাড়া কোন পথ ছিল না। দেশের অখন্ডতা বিপদের মুখে পড়েছিল।
যদিও প্রণব মুখোপাধ্যায়ের এই বক্তব্য দেশের রাজনৈতিক মহলে সার্বিকভাবে সমর্থন পায়নি।

৩. সঞ্জয় গান্ধী ও পারিবারিক স্বৈরতন্ত্র : সঞ্জয় গান্ধীর ঘনিষ্ঠ মহলের সদস্য ছিলেন প্রণব মুখার্জি। সঞ্জয় গান্ধীর একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে প্রণব মুখার্জি তাঁর নিজের মতো করে মতামত দিয়েছেন।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, অশিক্ষা দূরীকরণ, বনসংরক্ষনের মতো ক্ষেত্রগুলোতে পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন সঞ্জয় গান্ধী। যা প্রয়োজনীয় ছিল। কিন্তু যে পথে তা করতে গিয়েছিলেন সেগুলো সময় অনুযায়ী ঠিক ছিল না বলেই মনে করেন প্রণব মুখার্জি। তবে তিনি স্বীকার করেছেন সঞ্জয় গান্ধীর মধ্যে ভালো খারাপ দুই ছিল, যেমন সব মানুষের মধ্যে থাকে। ছয় বছর একসাথে সঞ্জয় গান্ধীর সঙ্গে কাজ করার জন্য প্রণব মুখার্জিও মুখোমুখি হয়েছেন সমালোচনার।

৪. The coalition years (১৯৯৬–২০১২) : জোট সরকারের শাসনে প্রণব মুখার্জি প্রত্যাশা করেছিলেন সনিয়া গাঁধী তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নির্বাচিত করবেন এবং মনমোহনকে রাষ্ট্রপতি হিসাবে নির্বাচিত করা হবে জোট সরকার গড়ার সময়। প্রণব মুখার্জি নিজেই স্বীকার করেছেন এ নিয়ে সনিয়া গান্ধী ভাবনা চিন্তা করছেন এমন খবর তাঁর কাছে এসেছিল। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। তিনি মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্ব মেনে নেন। বাধ্য হন একসময়ে তাঁর অধীনে কাজ কাজ করা মনমোহনের সিংয়ের নেতৃত্বে সরকারে যোগ দিতে। যদিও তিনিই ছিলেন যজ্ঞ ব্যক্তিত্ব প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য। তাকে যে বঞ্চিত করা হয়েছিল তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেয়। অবশ্য এনিয়ে কোন বক্তব্য রাখেননি কোনদিন। কিন্তু তার বদলা নিয়েছেন অন্যভাবে বলে রাজনৈতিক মহল মনে করে। কংগ্ৰেসের ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনীতির বাইরে গিয়ে তিনি আরএসএসকে স্বীকৃতি দেন। যা তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বিতর্কিত অধ্যায়।

প্রণব মুখার্জি তাঁর রাজনৈতিক জীবনে নানা উত্থান ও পতনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন। দীর্ঘ সময় ধরে ভারতীয় রাজনীতিকে চালিত করেছেন। রাজনৈতিক জীবনের বিতর্কিত অধ্যায়গুলোর ব্যাখ্যা দিয়েছেন নিজের মতো করো। যদিও তা সমালোচনার উর্ধ্বে নয়। তবু তিনি ভারতীয় রাজনীতির সেই বিরল ব্যক্তিত্ব যিনি তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের কাছ থেকেও সমান শ্রদ্ধা ও সমীহও আদায় করে নিয়েছেন।