কাঁটার আসনে বসে পূজো করা হয় দুবরাজপুরে পাহাড়েশ্বরের শ্মশানকালীর

লাল্টু : বীরভূমের শতাব্দী প্রাচীন কালীপুজো গুলির মধ্যে অন্যতম বীরভূমের পাহাড়েশ্বরের শ্মশান কালী। অন্যান্য কালীপুজোর মতোই কালীপুজোর অমাবস্যায় পূজো হয়, মন্দিরে থাকেন সারা বছর আর বিসর্জন দূর্গা পূজার পরের একাদশীতে। এই মা কালীর নাম শ্মশানকালী হওয়ার পিছনে একসময় এই এলাকায় শ্মশানের অস্তিত্বকেই বোঝায়।

মায়ের পুরোহিত তন্ময় দাস বৈষ্ণবের থেকে জানা যায়, প্রাচীনকালে এই এলাকায় শ্মশান ছিল, যা থেকেই এই কালির নাম হয়েছে শ্মশানকালী। কোন এক সময় এই মাকে তাদের পরিবারের কোন এক সদস্য কামাখ্যা থেকে নিয়ে এসেছিলেন। তারপর থেকে বংশপরম্পরায় তারাই পুজোর দায়িত্বে রয়েছেন। এই মায়ের পুজোয় আরও বিশেষত্ব হলো, ঠাকুর তৈরি করেন তারাই অর্থাৎ ওই বৈষ্ণব পরিবারই আর পূজোও করেন তারাই। মায়ের মূর্তি শুকানোর জন্য ব্যবহার করা হয় শ্মশানের পোড়া অবশিষ্ট কাঠের জ্বালানি, মায়ের অঙ্গরাগ থেকে শুরু করে যাবতীয় সমস্ত কিছু শ্মশানের সামগ্রী দিয়ে সাজানো হয়। এখানে মায়ের প্রতিমার পাশাপাশি থাকেন মায়ের দুই সঙ্গী ডাকিনী ও যোগিনী। বর্তমানে এলাকায় জনবসতি বেড়ে যাওয়ায় শ্মশান সরে গেছে।

কালীপুজোর রাতে পুজোর সময় যে আসন ব্যবহার করা হয়, সেই আসন হলো কাঁটার আসন। বংশপরম্পরায় এই রীতি চলে আসছে বলে জানা গিয়েছে ওই বৈষ্ণব বংশের পুরোহিতদের কাছ থেকে। পুজো হয় তন্ত্র মতে, যেখানে লাগে চ্যাং মাছ পোড়া, ছাগ বলি হয়। মন্দিরের পাশেই রয়েছে একটি জল কুন্ড। পাহাড়ি এলাকার পাথরময় পরিবেশে ওই কুন্ডর কাছে দু ফুট মাটি খোঁড়া হলেই জল পাওয়া যায়। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে মায়ের মূর্তি তৈরি হয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই সেই জল শুকিয়ে যায়।

পুজোর দায়িত্ব এলাকার ওই বৈষ্ণব পরিবার থাকলেও বিসর্জনের দায়িত্বে থাকেন এলাকার দাস পরিবাররা। শ্মশান কালী বিসর্জন হয় একাদশীর দিন। বিসর্জন ঘিরে একাদশীর দিন এলাকার দাস পরিবারের মধ্যে দেখা যায় আলাদা উৎসাহ-উদ্দীপনা, বাড়িতে বাড়িতে ভিড় জমান আত্মীয় স্বজনেরা, বিসর্জন ঘিরে পাহাড়েশ্বর শ্মশান চত্বরে বসে একদিনের জন্য মেলাও। তবে এই দাস পরিবারদের সেই দিনটি হলো সবথেকে বড় আনন্দের দিন, কারণ তারা সারা বছর পর একাদশীর দিনটিতে মায়ের বিসর্জনের অধিকার পান।

কিন্তু এসব সাধারণ রীতিনীতির পাশাপাশি আরও এক আশ্চর্য রীতি রয়েছে এই শ্মশানকালীকে কেন্দ্র করে। স্থানীয়দের দাবি অনুসারে এই শ্মশান কালী মা কোনো মতে বেদী থেকে নামতে চান না। অবশেষে দাস পরিবারের মানুষরা মাকে আপন ভেবে গালিগালাজ করে মাকে বেদী থেকে নামান ও সামনের রুজের পুকুরে বিসর্জন দেন।

আর এই শ্মশানকালীর বিসর্জনকে কেন্দ্র করে একদিনের জন্য মেলা বসে। সেই মেলাকে ঘিরে দুবরাজপুর এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষদের মধ্যে দেখা যায় চরম উৎসাহ উদ্দীপনা। এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা ছাড়াও দূর-দূরান্তের মানুষরা শুধুমাত্র এই বিসর্জন দেখতে ভিড় জমান এলাকায়।