করোনায় নারী ও পুরুষদের মধ্যে কারা বেশি ঝুঁকির মুখে, কি বলছেন বিশেষজ্ঞরা

নিজস্ব প্রতিবেদন : খুদে ভাইরাস করোনা বা কোভিড-১৯ বর্তমানে গোটা বিশ্বকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। তারপর আবার সাম্প্রতিককালের নানান গবেষণার রিপোর্ট মানুষকে আরও বেশি ভীত করে তুলেছে। এমনই এক গবেষণার রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে বিশ্বে করোনা সংক্রামিত রোগীদের মধ্যে নারীর তুলনায় পুরুষের সংখ্যা দ্বিগুণ। এমনকি প্রাণ হারানোর ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে পুরুষরা ৭৫%। অর্থাৎ করোনা সংক্রামিত হওয়ার ব্যাপারে এবং করোনা সংক্রমিত হয়ে প্রাণ হারানোর ব্যাপারে নারীদের তুলনায় পুরুষদের ঝুঁকি অনেক বেশি।

এই গবেষণা সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি প্রথম প্রকাশিত হয় ৩০শে জানুয়ারি। প্রকাশ করেন সাংহাইজিয়াওটং ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিনের একদল গবেষক। এই চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ পাওয়ার পর অন্য সকল দেশও বিশদ আকারে বিষয়টিকে নিয়ে গবেষণা করে। দীর্ঘকাল ধরে গবেষণা চলার পর তারা প্রত্যেকেই চিনা গবেষকদের এই দাবিকেই সমর্থন করে।

ইংল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ডে করোনা সংক্রামিত রোগীর সংখ্যা খতিয়ে দেখলেও নজরে পরে যে পুরুষের সংখ্যাই বেশি। এমনকি প্রাণ হারানোর হারেও নারীর তুলনায় পুরুষরাই এগিয়ে ছিল। নিউইয়র্কের হাসপাতালে চার হাজারেরও বেশী করোনায় সংক্রামিত রোগের উপর গবেষণা করে দেখা যায় সেখানে ৬২% পুরুষ প্রাণ হারিয়েছেন। যদিও সেখানে নারী ও পুরুষের সংক্রমণের সংখ্যা সমান ছিল।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০ই মার্চ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলে, “পশ্চিম ইউরোপে করোনায় মৃতদের মধ্যে ৭০% ছিল পুরুষ। বাংলাদেশেও করোনা সংক্রমিত রোগীদের মধ্যে ৬৮% ছিলো পুরুষ আর পুরুষদের মৃত্যুর হারও সেখানে ৭৩%।”

কেন নারীদের তুলনায় পুরুষের প্রাণ হারানোর হার বেশি? এ বিষয়ে গবেষকরা দীর্ঘ গবেষণা চালিয়ে কতগুলি কারণ পেয়েছেন। দেখে নিন সেগুলি কী কী?

১) ক্রোমোজোমের বিন্যাস : নারীদের প্রতিটি কোষেই দুটি X ক্রোমোজোম রয়েছে। অপরদিকে পুরুষের কোষে থাকে XY ক্রোমোজোম। নারীদের শরীরে যেহেতু দুটি X ক্রোমোজোম রয়েছে তাই তাদের টিএলআর প্রোটিন অংশটি পুরুষদের তুলনায় বেশি। কারণ X ক্রোমোজোমের মধ্যেই ৬০টি রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন জিন রয়েছে। তাই নারী শরীরে থাকা দুটি X ক্রোমোজোমের মধ্যে একটি রূপান্তর ঘটলেও তেমন কোনো অসুবিধা হয় না।

অপরদিকে পুরুষের শরীরে X ক্রোমোজোম একটি থাকার ফলে এটি রূপান্তর ঘটলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।

২) হরমোন : পুরুষের শরীরে থাকে টেস্টোস্টেরন নামক হরমোন। এই হরমোনের লেবেল যে সকল পুরুষের শরীরে কম তাদের কোভিড-১৯-এ প্রাণ হারানোর সম্ভাবনা বেশি। অপরদিকে নারীর শরীরে রয়েছে ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন নামক হরমোন যা নারীর শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে।

৩) রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা : নারীর শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা স্বভাবতই পুরুষদের তুলনায় বেশি। তাই নারীদের তুলনায় পুরুষদের সংক্রমণের ও প্রাণ হারানোর হারও বেশি।

৪) ধূমপান : পৃথিবীতে প্রায় বেশিরভাগ পুরুষ মানুষই ধূমপান করেন।যদি চীনের হিসাবেই ধরি তাহলে চিনে অর্ধেকেরও বেশি পুরুষ মানুষ ধূমপান করেন। অপরদিকে  নারীর ক্ষেত্রে ৫% নারী ধূমপান করেন চিনে। কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে প্রাণ হারানোর পিছনে ধূমপানও একটি বড় কারণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে, ধূমপায়ীরা কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হওয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে অধূমপায়ীদের তুলনায়।

৫) স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিধি : একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে পুরুষরা স্বাস্থ্য সম্পর্কে একটু কম সচেতন। তাই বারবার হাত ধোয়ার প্রবণতাটি তাদের মধ্যে দেখা যায় না। নারীরা স্বভাবতই স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ঝুঁকির দিকে যেতেই চান না। তাই স্বাস্থ্য সংক্রান্ত যাবতীয় বিধি নিষেধ নারীরা মেনে থাকেন।

৬) এনজাইম : কোভিড-১৯ সংক্রমণে এনজিওটেনসিন কনভারটিং এনজাইম-২ এর ভূমিকা নিয়ে ইউরোপিয়ান হার্ট জার্নালে একটি গবেষণা পত্র প্রকাশ করা হয়। এই গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নেদারল্যান্ডের ‘ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল সেন্টার গ্রোনিংএন’ এর কার্ডিওলজি অধ্যাপক এড্রিয়ান ভোরস।

হৃৎপিণ্ড, বৃক্ক ফুসফুস ও শুক্রাশয়ে প্রচুর পরিমাণে এনজিওটেনসিন কনভার্টিং এনজাইম-২ পাওয়া যায়। নানা রকমের গুরুত্বপূর্ণ ক্রিয়া যেমন পরিপাকে, বিপাকে সহায়তা করে থাকে এনজাইম। বয়স্কদের কার্ডিওভাসকুলার রোগের প্রবণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী করা হয়েছে এই এনজাইমকেই।

নেদারল্যান্ডের প্রকাশিত একটি গবেষণার রিপোর্ট এনজাইম-২ এর ভূমিকাকেই দায়ী করা হয়েছে। রক্তরসে এনজিওটেনসিন কনভারটিং এনজাইম-২ এর ঘনত্ব বেশি থাকায় পুরুষরা নারীদের তুলনায় করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বেশি প্রাণ হারাচ্ছে।