তিন শতাধিক প্রাচীন ‘লোবা মা’ বাগদি-বাউড়ি-শাঁখারিদের পুজো ছাড়া সন্তুষ্ট হন না

লাল্টু : কয়েক বছর আগে বীরভূমের দুবরাজপুর ব্লকের লোবা গ্রাম খোলামুখ কয়লা খনিকে কেন্দ্র করে অনিচ্ছুক জমিদাতাদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষে সংবাদ শিরোনামে উঠে এসেছিল। তবে এই গ্রামের রয়েছে আরও এক বড় পরিচিতি। যে পরিচিতি সেখানকার দীর্ঘ তিন শতাধিক প্রাচীন কালীপুজোকে কেন্দ্র করে। এই গ্রামের কালী মা গ্রামের নামেই, ‘লোবা মা’।

জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এই মায়ের পুজোয় রয়েছে নানান রীতি, মিথের ছড়াছড়ি। কথিত আছে, তিন শতাধিক বছর আগে অবধূত রামেশ্বরম দন্ডী ঘুরতে ঘুরতে এসে হাজির হন অজয় নদের তীরে এক নির্জন গ্রামে। সেখানেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন নিজের আরাধ্যা দেবীকে। যে গ্রামই বর্তমানে লোবা। আর সেই আরাধ্য দেবী হলেন ‘লোবা মা’। সেই পরিব্রাজক সাধু রামেশ্বর দণ্ডি এলাকার নিম্নবর্গের মানুষের সাথে মিশে পুজো করতেন। গ্রাম ছাড়ার আগে সেই সাধক পুজোর দায়িত্ব দিয়ে যান বর্তমান প্রজন্মের ১২ পুরুষ আগের দীনমনি ঘোষকে। সারা বছর পুজোর দায়িত্বে থাকে চক্রবর্তী পরিবার। তবে পুজোর অধিকার রয়েছে বাগদি, বাউরী, ধীবর সম্প্রদায়ের মানুষের।

মায়ের মূর্তি গড়ার ক্ষেত্রে বাগদি সম্প্রদায়ের মানুষের মাটি আনা ছাড়া মূর্তি তৈরি হয় না। মাটি আনা হয় প্বার্শবর্তী জেলা বর্ধমান জেলার নির্দিষ্ট পুকুর থেকেই। দশমীর দিন দেবী দুর্গার বিসর্জনের পর লোবা মায়ের কাঠামো নিয়ে আসা হয় পুকুর থেকে ঘোষ পরিবারে। তার আগে অজয় নদ পেরিয়ে বর্ধমানের গৌড়বাজারের তালপুকুরের ঈশান কোণ থেকে মাটি আনার দায়িত্ব পান বাগদি পরিবার। তারা মাথায় করে নিয়ে আসেন সেই মাটি। তারপর একাদশী থেকে শুরু হয় মায়ের মূর্তি তৈরির কাজ।

মূর্তি তৈরি করার কাজে ঘরের কাঠামো করার জন্য লাগে বাবুই দড়ি, যা বংশপরম্পরায় যোগান দেন বাউরি পরিবারের সদস্যরা। মূর্তি তৈরির কাজে হাত লাগান সূত্রধর পরিবারের সদস্যরা। মায়ের রঙ সম্পূর্ণ ভেষজ, বাজার থেকে কিনে আনা হয় না। তারপর পুজোর দিন মূর্তি তৈরি শেষ হলে ঘোষ পরিবারের সদস্যরা মাকে অলংকার পরিয়ে তুলে দেন ব্রাহ্মণদের হাতে। পুজোয় প্রদীপ জ্বালানোর জন্য যে ঘি ব্যবহৃত হয় তা বংশপরম্পরায় সরবরাহ করে থাকেন গোয়ালারা পরিবার। নিশিরাতে পুজো শুরু হওয়ার পর সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই দেবী চলে যায় ধীবরদের হাতে।

কথিত আছে, এই লোবা মায়ের বেদিতে যে শিলাখন্ড রয়েছে তাছাড়া বছর পুজো করা হয়। এই শিলাখণ্ড ধীবররাই গ্রামের কোন একটি পুকুর থেকে পেয়েছিলেন। তাই পুজোর দায়িত্ব সকালেই পান ধীবর সম্প্রদায়ের মানুষেরা।

এরপর মায়ের মূর্তি স্থানীয় এক কালিভাসা পুকুরে নিরঞ্জন করা হয়। বিসর্জনের দিন তিন বোন অর্থাৎ লোবা মা বড় বোন, বাবুপুরের মা মেজো বোন ও বরাড়ির মা ছোট বোনের একসাথে বিসর্জন হয়। সেদিন স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের মেয়ে জামাইকে আমন্ত্রণ করা হয় মেলা দেখার জন্য। শুধু আমন্ত্রণ নয়, মেলা দেখার জন্য তাদের নজরানাও দিতে হয়। তাই এই মেলা এবং পুজো সম্প্রীতির অনন্য চিত্র।

আর এখানেও রয়েছে শাঁখারিদের ভূমিকা। কথিত আছে, দুবরাজপুরের এক শাঁখারী একদিন লোবা গ্রামে শাঁখা বিক্রি করতে এসেছিলেন। সেসময় তার কাছে শাখা পড়েন এক অপরূপ সুন্দরী গৃহবধু। শাখা পরার পর ওই গৃহবধূ ঘোষ পরিবারের বামাপদ ঘোষকে নিজের পিতা পরিচয় দিয়ে তার কাছ থেকে টাকা নেওয়ার জন্য। সাথে বলেও দেন কুলুঙ্গিতে টাকা রাখা আছে বলে। আর শাখারির কথামতো বামাপদ ঘোষ সেদিন কুলুঙ্গি থেকে প্রচুর টাকা পান।

এও কথিত আছে, ছুটে এসে বামাপদ ঘোষ সেদিন পুকুরে শাঁখা পরা হাত দেখেছিলেন। লোক বিশ্বাস, বিসর্জনের পর দেবীর ডান হাত জল থেকে উঠে যায়।