করোনা চিকিৎসায় অনুদান করেও ঘুণাক্ষরে কাউকে জানতে দেননি ইরফান খান

সঙ্গীতা চৌধুরী : কর্মই মানুষকে অমর করে রাখে। মানুষ কী বলছে সেটা তার চরিত্র নয়, মানুষ কী করছে সেটাই আসলে তার চরিত্র। হ্যাঁ বর্তমান যুগে সামান্য অনুদান দিতে গিয়েও যখন মানুষ ক্যামেরা সাথে নিয়ে যায়, তখন সম্পূর্ণ গোপনে নীরবে দান করে যান কিছু মানুষ।পেশাগত জীবনে তিনি একজন অভিনেতা হলেও বাস্তব জীবনে তিনি ছিলেন একজন উঁচুদরের মানুষ। যার ভালোমানুষীর মধ্যে খাদ ছিলো না কোনও দিন, তা আরও একবার প্রমাণ হয়ে গেল।

তিনি এমন একজন অভিনেতা যিনি শুধু বলিউড এবং হলিউডকে নয় পুরো বিশ্বকেই আকৃষ্ট করে গেছেন তাঁর জীবদ্দশায়। লাইফ অফ পাই, স্লামডগ মিলিয়নিয়ার ও জুরাসিক ওয়ার্ল্ডের মত চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন।বলিউড-হলিউডের নানান সিনেমাতে অভিনয় করার পাশাপাশি বাংলাদেশের বহুল আলোচিত একটি চলচ্চিত্র ‘ডুব’-এর মূল ভূমিকাতেও ছিলেন এই অভিনেতা। জন্মসূত্রে ছিলেন রাজবংশের সন্তান কিন্তু অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। হতে চেয়েছিলেন ক্রিকেটার কিন্তু হয়ে গেলেন অভিনেতা। লম্বা রেসে দৌঁড়াতে চেয়েছিলেন কিন্তু আয়ু ছিল অল্প। মাত্র ৫৪ বছরে চলে গেলেন তিনি। তাঁর শেষ করা অভিনয় ছিলো আংরেজি মিডিয়াম। হ্যাঁ, তিনি ইরফান খান। যিনি তাঁর জীবদ্দশাতেই করোনা সংক্রমিতদের জন্য দান করে গেছিলেন কিন্তু তাঁর একটি শর্ত ছিল। শর্তটি ছিল একটাই তাঁর এই দানের কথা কেউ জানবে না। ইরফান খান আবারও প্রমাণ করে দিলেন কর্মই মানুষকে বড় করে তোলে।

তাঁর মৃত্যুর এক মাস পর জানা গেল করোনা তহবিলে তাঁর অনুদানের কথা। জয়পুরে তাঁর একজন বন্ধু জিয়াউল্লাহ সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, “অভিনেতা ইরফান খান ছিলেন মাটির মানুষ। খ্যাতির লোভ তার কোনদিনই ছিলে না। তাই করোনা তহবিলে দান করার আগে তাঁর একটাই শর্ত ছিল, তাঁর এই দানের কথা যেন গোপন থাকে।”

জিয়াউল্লাহকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। আর সেই শর্তেই টাকা দান করেছিলেন। তাই অভিনেতার জীবদ্দশাতে জিয়াউল্লাহ একথা প্রকাশ করেননি কাউকে।

কিন্তু এখন একটি সাক্ষাৎকারে প্রকাশ্যে এসেছে এই ঘটনা। জিয়াউল্লাহ এপ্রসঙ্গে আরও বলেন, “করোনা সংক্রমণ মহামারী আকার নিতেই তিনি ঠিক করেছিলেন ত্রাণ তহবিল করবেন। সেখানে সবাই নিজেদের সাধ্যমত ত্রাণের জন্য অর্থ সাহায্য করবেন। ইরফানের ভাইকে ত্রাণ তহবিলের কথা জানাতেই ইরফানের ভাই খুশি হয়ে অর্থ দান করেন ত্রাণ তহবিলে। এরপর অভিনেতা ইরফান খানকে জানানো হয় করোনা ত্রাণ তহবিল গঠনের কথা। এই কথা শোনার পরে ইরফান জানান যে তিনি তাঁর সাধ্যমত অর্থ দান করবেন ত্রাণ তহবিলে কিন্তু একটি শর্তে। এই দানের কথা যেন সম্পূর্ণভাবে গোপন থাকে। কেউ যেন জানতে না পারে তাঁর করা এই দান।”

করোনা ত্রাণ তহবিলে দান করার আগেও তিনি অনেকবার দুঃস্থ মানুষদের জন্য দান করেছেন। মহারাষ্ট্রের ইগতপুরি গ্রামের দুঃস্থ পরিবারের বাচ্চাদের পড়াশোনার দায়িত্বও নিয়েছিলেন ইরফান। বাচ্চাদের নিয়মিত তিনি বইপত্র কিনে দিতেন এছাড়া সেই গ্রামে একটি স্কুল খোলার জন্য তিনি উদ্যোগী হয়েছিলেন। স্কুলটি খোলার জন্য তিনি অনেক টাকা খরচ করেছিলেন। এছাড়া ওই গ্রামের মানুষদের স্বাস্থ্য পরিষেবার কথা ভেবে কিনে দিয়েছিলেন বেশ কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্সও।

আসলে প্রচার করে দান করার বিরোধী ছিলেন ইরফান। তিনি বিশ্বাস করতেন যে প্রতিটি মানুষেরই নীরবে সাহায্য করা উচিত। প্রচার করে দান করলে যিনি দান গ্রহণ করেন তাকে ছোট করা হয়। তাই চিরকাল নীরবে অজান্তে দান করে গেছেন তিনি। একজন মানুষ যখন প্রকৃত উদারমনস্ক হন তখন তিনি প্রতিটি মানুষকেই সম্মান দান করেন। নিজের করা দানকে প্রচার করে তিনি দান গ্রহণকারীকে কখনোই ছোট করতে চান নি। উদারমনস্ক মানুষদের এই লক্ষণ। এই কারণেই উদার মানুষরা বেঁচে থাকেন মৃত্যুর পরও। ঠিক যেমন ভাবে মৃত্যুর এক মাস পরেও আজ ও ইরফান খান সমানভাবে আলোচিত তার কর্মের জন্য। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই বছরই ২৯ এপ্রিল মারা যান অভিনেতা ইরফান খান।