স্রষ্টা রতন কাহারকে স্বীকৃতি না দিয়েই কোটি টাকা কামাচ্ছে বাদশার ‘গেন্দা-ফুল’

নিজস্ব প্রতিবেদন : ‘আমার গান শুনে যান ওগো বাবু সুখেরই সংসারে/আমি এখন শুকনো পাতা কখন যাবো উড়ে!’ শিল্পীর জীবন যন্ত্রণাই যেন সার্থক রূপ পেলো তাঁর গলার এই গানে। শুকনো পাতা! যে শিল্পীর গান নিয়ে আজও এত রমরমা চারিদিকে সেই শিল্পী নিজেকে মনে করছেন শুকনো পাতা! সত্যি এ এক ট্রাজিক মুহূর্ত যখন আমরা একজন শিল্পীর থেকে তাঁর শিল্পের সবটুকু কেড়ে নিই অথচ বদলে তাঁর প্রাপ্য এতটুকু সম্মানও দিইনা!

বীরভূমের সিউড়ির চার নম্বর ওয়ার্ডের সোনাতর পাড়ার নগড়ি পাড়ায় রতন কাহার। চার ছেলে মেয়ের কেউই মাধ্যমিক পাশ করতে পারেননি অভাবের কারণে। মেয়ে ভালো গান গাইলেও একটা হারমোনিয়াম কিনে দিতে পারেননি তিনি! সেই বৃদ্ধ মানুষটি তাকে আমরা সবাই ভুলে গেছি। যদিও তার গান এখন ইউটিউবের সোনি ইন্ডিয়া চ্যানেলের একনম্বর ট্রেন্ডিং! অথচ শিল্পীর দিন কাটে এখনও অভাব অনটনে।

হ্যাঁ, ইনি সেই রতন কাহার যার গান ‘বড় লোকের বিটি লো’ বিটিকে বেচে যিনি অর্থ নেন না। ১৯৭৬ সালে স্বপ্না চক্রবর্তীর গলায় গাওয়া -‘বড়লোকের বিটি লো লাল গেন্দা ফুল’ গানটির স্রষ্টা যিনি। লোকসঙ্গীত, ঝুমুর, প্রভাতী কীর্তনে যার জুড়ি মেলা ভার। সেই মানুষটিকে লোকে ভুলতেই বসেছে।

Rap গায়ক বাদশা ও পায়েল দেবের গাওয়া রতন কাহারের বিখ্যাত লোকসঙ্গীতটি মিউজিক ভিডিও আকারে ও নতুন মোড়কে লঞ্চ করেছে সোনি মিউজিক ইন্ডিয়া। যে মিউজিক ভিডিওর গানে প্রধান মুখ অভিনেত্রী জ্যাকলিন। অথচ রতন কাহারের নাম উল্লেখ নেই কোথাও। যে গানের মধ্য দিয়ে কোটি কোটি টাকা লুটছে সোনি সংস্থা ও বাদশা, সেই গানেই সুকৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হলো রতন কাহারের নাম, গানের স্রষ্টার নাম!

কেন এই অনুল্লেখ? স্রষ্টার নাম কেন দেওয়া হলো না মিউজিক ভিডিওতে। রতন কাহারের নাম মিউজিক ভিডিওতে উল্লেখ করলে তাকে দিতে হবে একটা মোটা অঙ্কের রয়্যালিটি! এই কারণেই কি তার নাম উল্লেখ করা হলো না মিউজিক ভিডিওতে! লোকসঙ্গীতকে সাজানো হলো র‍্যাপের আদলে। লোকসঙ্গীতের বারোটা যা বাজার তা তো বাজলোই, কিন্তু এই গানে স্রষ্টার নাম অনুলেখ্য, এটি অত্যন্ত নিন্দনীয় ব্যাপার। যা নিয়ে ছিঃ ছিঃ কার উঠেছে নেটিজেনদের মধ্যে।

Rap দেওয়া এই গানটির নতুন নাম ‘গেঁদা ফুল’। সোনি মিউজিক ইন্ডিয়া তাদের ইউটিউব চ্যানেলে যেদিন প্রথম গানটি রিলিজ করে সেদিনই এক কোটি মানুষ দেখে ফেলেছেন গানটি। ইউটিউবের ১ নম্বর ট্রেন্ডিং এখন এই গান।

অনেকেই এই গানের তীব্র নিন্দা করেছেন।লোকসঙ্গীতকে নিয়ে এইভাবে ছেলেবেলার বিরোধীতা করেছেন। অনেকেই হয়েছেন সমালোচনায় মুখর। আবার অনেক মানুষ আছেন যারা অপরাধ বোধে ভুগছেন। অপরাধবোধ স্রষ্টার নাম অনুল্লেখের, স্রষ্টার অসম্মানের।

স্বপ্না চক্রবর্তীর গাওয়া গানটি বাঙালির প্রথম পছন্দের। ১৯৭২ সালে এই গানটি লেখেন রতন কাহার। হ্যাঁ রতন কাহার অনেক ছোটো বড় জায়গাতে সম্মান ও সম্বর্ধনা পেয়েছেন বারংবার। কিন্তু তাঁর পারিবারিক দুরাবস্থা কিন্তু কাটেনি। এত সম্মান এত সম্বর্ধনার বদলে যদি অল্প কিছু অর্থ তিনি পেতেন তাহলে তাঁর পরিবারের মানুষগুলি একটু খেয়ে পরে ভালো ভাবে বাঁচতো। যদিও এই নিয়ে শিল্পী রতন কাহারের কোনো আক্ষেপ নেই। শিল্পী মানুষ তিনি শিল্প সৃষ্টিতেই তাঁর আনন্দ। পারিবারিক ভগ্নদশা তাঁর মনে লেখা পাঁচ করে না। কিন্তু এই লজ্জা আমাদেরই। এই লজ্জা সভ্যতার। যেখানে একজন মানুষ একটা দুটো গান গেয়েই অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়ে যান সেখানে রতন খাবারের দিন কাটে আজও দারিদ্রের মধ্যেই। এই লজ্জা আমাদেরই যখন শুনি যে আজ রতন কাহার এতোটাই নি‍ঃস্ব যে একটা হারমোনিয়াম কেনার মতো টাকাও তাঁর কাছে নেই। তবু গান ছাড়েন নি তিনি।

রতন কাহারের ছেলের আক্ষেপ, “বাবার সাথে অনেক জায়গায় গিয়েছি। অনেক অনুষ্ঠানে। বাবাকে সকলেই সম্মান করেন। কিন্তু দুঃখ একটাই বাবা কোনো সুযোগ পেলোনা অথচ বাবার গান গেয়ে সকলেই বড়লোক হয়ে গেলো।”

পাড়া প্রতিবেশীর কথায়, “খুব ভালো মানুষ। অনেকেই আসেন তাঁর কাছে।গান নিয়ে যান। মুখে মুখে গান বাঁধেন তিনি।”

স্বপ্না চক্রবর্তীর গলায় রিলিজ হ‌ওয়া গানের সুর লেখা সবটাই রতন কাহারের অথচ স্বীকৃতি পান নি তিনিই! আজও তার গান গেয়ে সকলে প্রতিষ্ঠিত অথচ তিনি প্রচারের আলো থেকে ছিটকে!অভাবের সংসার তাঁর! আফসোস করেন তাঁর সন্তানেরা অথচ শিল্পীর কোনো আক্ষেপ নেই!রতন কাহারের কথায়, “আমার কোনো কষ্ট হয় না এতে। কষ্ট হলে গত পঞ্চাশ বছর ধরে আমি গান গাইতাম না। হ্যাঁ, তবে আমার আফসোস হয় আমার ছেলেমেয়েদের জন্য।কারণ ওরা বিরক্ত হয়ে গেছে। আমার স্ত্রী ছেলেমেয়েরা বলে তুমি কাউকে কিছু বলবেও না কিছু লিখেও দেবেনা। আমি যাই তো অনেক জায়গায় আমি সম্বর্ধনা নিয়ে বাড়ি এলে কেউ খুশি হয় না।টাকাপয়সা দিলে খুশি হয়। এই তো আমার জীবন। কিন্তু আমি যাই কেন বলুন তো আমার সম্মানের জন্য”, হ্যাঁ এই একজন শিল্পী। বাদশা সোনি ইন্ডিয়া একটা ভিডিও লঞ্চ করেও যার কাছাকাছি পৌঁছাতে পারবেনা কখনো। কারণ শিল্পীরা চিরকাল এভাবেই ধ্বংস স্তূপের মধ্য দিয়ে নির্ভীক ভাবে গান গেয়ে যান, রচনা করে যান! মাইকেল, নজরুল থেকে মানিক সকলের জীবনেই এই অনটন ছিলো। সাহিত্যকরা এরকম যন্ত্রণাময় জীবনই কাটান। যে জীবনে বেঁচে থাকতে স্বীকৃতি পাননি জীবনানন্দও সেই যন্ত্রণা দায়ক জীবনই পছন্দ রতন কাহারের। তিনি টাকা চান না তিনি সেই শিল্পীর বেদনার্ত জীবনেই খুশি। কিন্তু তবু বলতেই হয় মাণিক, মাইকেল এনারা তাদের রচনাতে নিজেদের নাম টুকু পেয়েছিলেন কিন্তু পুঁজিবাজারে লড়াইয়ে এই শিল্পী আজ তারই গানে নামটুকুও হারালেন! তবু তিনি অমর! নীলকন্ঠের মতোই যাবতীয় অভাবের বিষ গলায় ধারণ করে গেয়ে যাবেন, “সরে আয় ভাদু তোর মাথা বেঁধে দিই!পাড়ার লোকে বলবে কী!” -এই গলায় গান যে শুনেছে সে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকবে অপলক!আপনাকে যোগ্য সম্মান দিতে পারিনি আমরা! এই আমাদের লজ্জা!