নিজস্ব প্রতিবেদন : সুশান্তের মৃত্যু রহস্যে বঙ্গতনয়া রিয়া চক্রবর্তীর নাম জড়িয়েছে। প্রয়াত অভিনেতার বাবা কে কে সিং রিয়া চক্রবর্তীর নামে এফআইআর দায়ের করেছেন। একাধিক অভিযোগে অভিযুক্ত সুশান্তের এই বান্ধবী। সুশান্তের উপর কালা জাদু করা থেকে শুরু করে সুশান্তকে ওভার ডোজের ওষুধ দেওয়া এবং সুশান্তের ওপর মানসিকভাবে নি’র্যাতন করা ইত্যাদি নানা অভিযোগ তার ওপর আনা হয়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই অধিকাংশ মানুষই রিয়া চক্রবর্তীর উপর ক্ষুব্ধ। তবে রিয়া চক্রবর্তীকে নিয়ে ট্রোল করতে গিয়ে সমগ্র বাঙালি সমাজকে টানা হবে এটা মেনে নেওয়া যায় না। কারণ এক রিয়া চক্রবর্তীকে দিয়েই বাঙালি জাতির বিচার হয় না। এই জাতিতে যেমন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আছেন, তেমনই আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সত্যজিৎ রায়, উত্তম কুমারের মতো প্রতিভাবানরা। আবার রানী মুখার্জি, কাজল ও সুস্মিতা সেনের মত বাঙালি নায়িকারা ও বলিউডের বিরাজ করছেন স্বমহিমায়। তাই কোনো একজনের দোষ ত্রুটির জন্য সমগ্র জাতিকে কাঠগড়ায় তুলে দেওয়ার বিপক্ষে দাঁড়ালেন টলিউডের দুই নামকরা বাঙালি অভিনেত্রী।
রিয়া চক্রবর্তীর নামে একের পর এক অভিযোগ আসার পর প্রথমদিকে রিয়া চক্রবর্তীকেই ব্যক্তিগত কটাক্ষ করা হতো। কিন্তু পরবর্তীকালে তা ছাড়িয়ে চক্রবর্তী পদবীধারী মেয়েদের ও বাঙালি সমাজের সকল নারীকে নিয়ে ট্রোল করা শুরু হয়। ফেসবুকের ওয়ালে ভেসে বেড়াতে থাকে কতগুলি কথা, ‘বাঙালি মেয়ে মানেই খারাপ’, ‘বাঙালি মেয়েরা পয়সার কাঙ্গাল’, ‘বাঙালি মেয়েরা কালা জাদুতে সিদ্ধহস্ত’, ‘বাঙালি মেয়েরা প্রতিভাবানদের মাথা খেতে ওস্তাদ!’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
বিগত কয়েকদিন আগে সুশান্তের দিদি মিতু সিংহ বলেন, রিয়া তার ভাইয়ের উপর কালা জাদু করেছে। মিতুর বন্ধু স্মিতা পারিখও সংবাদমাধ্যমকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “রিয়া আমাকে জানিয়েছিল যে ওর এক প্রিয় বন্ধু কয়েক বছর আগে মারা যায়। কিন্তু সেই বন্ধুর আত্মা সবসময় রিয়ার সাথেই থাকতো। নানা বিপদ থেকে রক্ষা করত রিয়াকে। এমনকি বিয়ার কেউ অনিষ্ট চাইলেও তাকে শেষ করে দিতে রিয়ার বন্ধুর সেই অতৃপ্ত আত্মা।”
এরপর সোশ্যাল মিডিয়াতে সরাসরি বাঙালি জাতিকে নানান খারাপ মন্তব্য লেখা হয়, “Yepp…I hard that Bengalis know how to call ghost… She would have done black magic on Sushant sir…” অর্থাৎ “আমি শুনলাম যে বেঙ্গলি মেয়েরা জানে কীভাবে আর আত্মাদেরকে আহবান করতে হয়! রিয়া সুশান্তের উপর ব্ল্যাক ম্যাজিক করেছিল!”
আরেকজন আবার এর থেকেও একধাপ এগিয়ে বলেন, “And everyone knows about the black magic acts of Bengal practiced a lot of people to control others life… this is very serious Riya should be given life sentence.” অর্থাৎ “সকলেই জানেন যে বাঙালিরা দীর্ঘদিন ধরে কালাযাদু চর্চা করে আসছে অন্যান্য ব্যক্তিদেরকে নিজেদের আয়ত্তে আনার জন্য। রিয়া যেটা করেছে তার জন্য তার শাস্তি প্রাপ্য।”
এই ভাবেই রিয়া চক্রবর্তীকে ছেড়ে বাঙালি জাতির উপর একের পর এক রোষানল উপচে পড়তে থাকে সোশ্যাল মিডিয়ার প্লাটফর্মে। একজন ব্যক্তি তো সরাসরি লেখেন, “রিয়া বাঙালি তাই ব্ল্যাক ম্যাজিক ওর রক্তে।” আর একজন টুইটারে লেখেন, “বাঙালি মেয়েরা সব সময় ছেলেদের দমিয়ে রাখে। পয়সাওয়ালা ছেলেদের ফাঁসায়। যদি তুমি তোমার স্ত্রীর চাকর এবং একইসঙ্গে পয়সা যোগানোর মেশিন হতে চাও তবে বাঙালি মেয়ে বিয়ে করতে পারো। মনে রেখো নিজের পরিবার ছেড়ে আসতে হবে তোমাকে।”
এইভাবে বাঙ্গালীদের উপর নানান মন্তব্য মোড় ঘুরে যেতে থাকলে নেটিজেনদের একটা বড় অংশের বিরোধিতা করতে থাকেন। এরপরেই এই বিরোধিতায় শামিল হন টলিউডের দুই বাঙালী অভিনেত্রী নুসরাত জাহান ও স্বস্তিকা মুখার্জি। বাঙালি গর্বে গর্বিত দুই অভিনেত্রী মোক্ষম জবাব দিতে থাকেন।
We "Bengali Girls" also run around - cook n conquer the world. Stop disgracing a community for your Agendas.
I'm sure you don't know your Maach-Masala-Mishti well ?
? ?? https://t.co/lyzRXDTt8K— Nusrat (@nusratchirps) August 1, 2020
নুসরত টুইটে লেখেন, “আমরা বাঙালি মেয়েরা রান্না করার সাথে সাথে সারা বিশ্বও জয় করতে পারি। শুধুমাত্র স্বার্থের জন্য একটা গোটা সম্প্রদায়কে অপমান করবেন না। আমি নিশ্চিত মাছ, মশলা, মিষ্টি সম্পর্ক খুব একটা কিছু জানেন না আপনি।”
রিয়ার ব্যাপারে নুসরতের বক্তব্য খুব পরিষ্কার। তিনি রিয়াকে সমর্থন করছেন না। রিয়া অন্যায় করে থাকলে তার শাস্তিই প্রাপ্য। কিন্তু রিয়ার মত একজনের জন্য গোটা বাঙালি সমাজকে অপমান করার বিরোধিতা করছেন তিনি। তিনি বলেছেন, “যা কিছু আইনবিরুদ্ধ মানবতা বিরুদ্ধ তাতে আমার সমর্থন নেই। আমি নিশ্চিত পুলিশ তাদের কাজ করছে। আশা করছি খুব শীঘ্রই সত্য আমাদের সামনে আসবে। কিন্তু তাই বলে কেউ আমাদের সংস্কৃতিকে অপমান করবে তা আমি একেবারেই বরদাস্ত করবো না।”
অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ও বাঙালি জাতিকে এই ভাবে অসম্মান করার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। টুইটে একজন ব্যক্তি লেখেন, “বাঙালিরা মাছ ধরে, পয়সাওয়ালা ছেলেদেরই তাদের পছন্দ।” এই কথার উত্তরে স্বস্তিকার জবাব, “আমিতো রুই বা ভেটকি ভালোবাসি। এরপর সর্ষের তেল দিয়ে তা ভালো করে রান্না করে গরম ভাতে কাঁচালঙ্কা দিয়ে খেতে ভালোবাসি। বাঙালি মেয়েরা কেউ আছো জয়েন করবে আমার সাথে?”
Yes I prefer Rui or Bhetki, then fry it in mustard oil and finish it off with steaming rice with some green/red chillies.
Bengali women out there. Anyone wants to join in ?
? ? ? ? ?? https://t.co/GaDibcPxCN— Swastika Mukherjee (@swastika24) July 31, 2020
এরপর স্বস্তিকা ও নুসরতের কমেন্ট বক্সে বাঙালি ও অবাঙালি অধিকাংশ মানুষই একমত হয়েছেন। একজন যেমন লেখেন, “রিয়া যদি দোষী হয়েও থাকে আইন রয়েছে বিচার ব্যবস্থা রয়েছে তার জন্য। তাই বলে একটা গোটা সম্প্রদায় কে এইভাবে অপমান করা কি আদৌ ঠিক? আমার স্ত্রী ও একজন বাঙালি। আমার জীবনে ও না থাকলে আমার কী হতো আমি জানি না।”
আর এক জন বলেন, “আপনারাই বিভাজন সৃষ্টি করছেন। আপনাদের জন্যই ঐক্যে আঘাত পড়ছে। সংহতি নষ্ট হচ্ছে। ভুলে যাবেন না, জাতীয় সঙ্গীত ও কিন্তু বাংলা ভাষাতেই লেখা!”
এইভাবেই অধিকাংশ মানুষই জাতের রেষারেষি ভুলে দুই অভিনেত্রীর সঙ্গে সহমত পোষণ করেন। ভালো মন্দ সব জায়গাতেই রয়েছে। তাই কোন একজনের জন্য সমগ্র সমাজকে দোষ দেওয়া মানবতারই অবক্ষয়।রাখি পূর্ণিমার বিশেষ দিনে এই সকল জাতিভিত্তিক রেষারেষি ভুলে গিয়ে সম্প্রীতির বন্ধন তৈরী করুন, এতেই মানবতার যথার্থ সার্থকতা লুকিয়ে আছে।