প্রফেসর থেকে সাংবাদিক-নেতা থেকে রাষ্ট্রপতি, হাজারো গুণের অধিকারী প্রণব মুখোপাধ্যায়

নিজস্ব প্রতিবেদন : ভারতীয় রাজনীতিতে প্রণব মুখার্জির পরিচয় চাণক্য হিসাবে। স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতের রাজনীতিতে তিনি ছিলেন এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। জনসমর্থনহীন কিন্তু রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও সরকার পরিচালনার দক্ষতা তাকে ভারতীয় রাজনীতিতে দিয়েছে বিশিষ্ট স্থান। ইন্দিরা গান্ধীর হাত ধরে তাঁর উত্থান হয় ভারতীয় রাজনীতিতে। ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থমন্ত্রী পদে কখনও মনমোহন সিংয়ের সময় বিদেশ মন্ত্রকের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। পৌঁছেছেন ভারতীয় গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রপতি পদে।

১৯৬৯ সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাকে কংগ্ৰেসের টিকিটে রাজ্য সভায় নিয়ে আসেন। খুব দ্রুত তিনি ইন্দিরা গান্ধীর বিশ্বস্ত ‘কিচেন ক্যাবিনেটের’ সদস্য হয়ে উঠে মন্ত্রীত্ব পান ১৯৭৩ সালে। ইন্দিরা গান্ধীর ডাকা জরুরী অবস্থার সময় (১৯৭৫-৭৭) ইন্দিরা গান্ধীর চূড়ান্ত সমর্থক হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৮৩-৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি অর্থমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। সেই সঙ্গে ১৯৮০ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত রাজ্যসভার নেতা হিসাবে দায়িত্বভার পালন করেন।

১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর হ’ত্যা হলে কংগ্ৰেস দলে ক্ষমতায় আসেন রাজীব গান্ধী। রাজীব গান্ধীর সঙ্গে মতোবিরোধ তাকে কংগ্ৰেসের দলীয় ক্ষমতার মূল কেন্দ্র থেকে সরিয়ে দেয়। তিনি রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্ৰেস নামে একটি দল গঠন করেন। যদিও তা সাফল্য লাভ করেনি। ১৯৮৯ সালে প্রণব মুখার্জি তাঁর দলকে আবার কংগ্ৰেসের সঙ্গে মিশিয়ে দেন রাজীব গান্ধীর সঙ্গে বোঝাপড়ায় আসার পর।

১৯৯১ সালে রাজীব গান্ধীর হ’ত্যা হলে কংগ্ৰেসের রাজনীতিতে পুনরায় শক্তিশালী নেতা হিসাবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে। প্রধানমন্ত্রী পি. ভি. নরসিমা রাও ১৯৯১ সালে প্ল্যানিং কমিশনের প্রধান হিসাবে তাকে নির্বাচন করেন। এবং বিদেশ মন্ত্রকের দায়িত্ব পান ১৯৯৫ সালে। এই সময়কালে সনিয়া গান্ধী কংগ্ৰেসের হাল ধরলে কংগ্ৰেস পরিচালনায় তিনি হয়ে প্রধান ব্যক্তি।

২০০৪ সালে প্রণব মুখার্জির রাজনৈতিক জীবনে শীর্ষ বিন্দুতে পৌঁছায়। কারণ এতদিন ধরে তিনি কোন নির্বাচনে জয়লাভ করে সংসদে আসতে পারেন নি। যে জন্য জনসমর্থনহীন বড় নেতা বলে বিরোধীদের তির্যকের পাত্র ছিলেন। এই প্রথম জঙ্গিপুর লোকসভা থেকে ভোটে জয়ী হয়ে লোকসভাতে প্রবেশ করেন। তখন ২০১২ সালে পদত্যাগ পর্যন্ত মনমোহন সিং সরকারের সর্বোচ্চ দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসাবে দায়িত্বভার পালন করেন।

২০০৪ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দায়িত্ব সামলান। ২০০৬ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত পররাষ্ট্র দপ্তর ও ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব গুরুত্বের সঙ্গে পালন করেন। ছিলেন লোকসভায় প্রধান নেতার ভূমিকাতেও। ২০১২ সালে পি. এ. সাংমাকে পরাজিত করে ভারতের ১৩ তম রাষ্ট্রপতি হন। ২০১৯ সালে তিনি ভারতরত্ন সম্মানে সম্মানিত হন।

পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার মিরাটি গ্ৰামে ১৯৩৫ সালে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্ৰহণ করেন। বাবা কামদাকিঙ্ক্ষর মুখার্জি ছিলেন কংগ্ৰেসের বড় নেতা ও সুভাষ চন্দ্র বসুর সহযোগী। ছিলেন কংগ্ৰেসের এআইসিসির সদস্য। মা রাজলক্ষ্মী মুখার্জি। স্ত্রী শুভ্রা মুখার্জি মারা গেছেন কয়েক বছর আগে। বর্তমানে আছেন দুই পুত্র ও এক কন্যা। বিদ্যালয়ের পড়াশোনা কীর্ণাহার শিবচন্দ্র হাইস্কুলে। গ্ৰাজুয়েট হন বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে। মাস্টার ডিগ্ৰি করেন পলিটিকাল সায়েন্স ও ইতিহাসে। সেই সঙ্গে এলএলবিও করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৯৬৩ সালে তিনি বিদ্যাসাগর কলেজে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসাবে কাজে যোগ দেন। রাজনীতিতে প্রবেশ করার আগে তিনি ‘দেশের ডাক’ পত্রিকায় সাংবাদিক হিসাবেও কাজ করেন।

ভারতে যে ক’জন ব্যক্তির হাত ধরে নতুন অর্থনৈতিক যুগের সূচনা হয়েছিল তিনি তাদের মধ্যে অগ্ৰগণ্য। অনুপ্রাণিত হয়েছেন ডেং জিয়াং পিয়াংয়ের দ্বারা। ভারতের দীর্ঘ ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির তিনি যেমন সমর্থক তেমনি ভারতীয় সংস্কৃতির মূল ধারাকেও তিনি অস্বীকার করেন নি। নাগপুরে আরএসএসের কার্যালয়ে তাঁর উপস্থিতি ভারতীয় রাজনীতির এক নতুন পদক্ষেপের স্বীকৃতি দেয়।

তিনি ছিলেন ভারতীয় রাজনীতির চাণক্য, প্রশাসন চালানোর দক্ষ কারিগর, দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কালীমাহীন সৎ এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।