অন্তর্ধানের রহস্য আজও অধরা, ঘরে ফিরলেন না নেতাজি

নিজস্ব প্রতিবেদন : সুভাষ ঘরে ফেরে নাই। সুভাষ চন্দ্র বসু সম্বন্ধে বাঙালি তথা দেশের মানুষ এই কথাই মনে করে। দেশের মানুষ কয়েক দশক ধরে অপেক্ষা করেছেন সুভাষচন্দ্র বসু ফিরে আসবেন এবং দেশের শাসনভার গ্ৰহণ করবেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি আপামর দেশবাসীর।

১৯৪৫ সালের ১৮ই আগস্ট জাপানের তাইহোকু বিমানবন্দরে তাকে শেষ দেখা যায়। ১৮ আগষ্ট এবছর নীরবে পেরিয়ে গেল। করোনা মহামারীর কারণে দেশের মানুষ খেয়ালই করেনি এই দিনে তাদের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি হারিয়ে গিয়েছিলেন। তথ্যপ্রযুক্তির এই বিস্ফোরণের যুগেও মেলেনি সুভাষচন্দ্রের অন্তর্ধানের রহস্যের সঠিক সমাধান।

তাইহোকু বন্দরে বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর শেষ সঙ্গি ছিলেন আবিদ হোসেন। দুর্ঘটনায় তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন। বহু বছর পর পাকিস্তানে তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষচন্দ্র বসু মারা যান না বেঁচে গিয়েছিলেন। রহস্যজনকভাবে তিনি কোন উত্তর দেননি। এবিষয়ে সারা জীবন নীরব থেকেছেন। যদিও এই বিশ্বস্ত আবিদ হোসেনের সঙ্গেই তিনি ডুবো জাহাজে করে জার্মানি থেকে জাপান উপকূলে এসেছিলেন। কিন্তু জানাননি কোন কিছু সুভাষচন্দ্রের মৃত্যু সম্বন্ধে।

স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে জহরলাল নেহেরুর বোন বিজয়লক্ষ্মী পন্ডিত রাশিয়ায় সুভাষচন্দ্রকে দেখতে পাওয়ার কথা ইঙ্গিতে জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই ঘোষণা দ্রুত ধামা চাপা দেওয়া হয়। যা আজও আলোচিত হয় না কোন ফোরামে।

কেন স্বাধীনতার এত বছর পরেও সুভাষচন্দ্র বসুর অন্তর্ধান রহস্য সমাধান করা গেল না?

এর পেছনে আছে ভারতীয় রাজনীতির এক না জানা ইতিহাস। সুভাষ চন্দ্র বসু ছিলেন ১৯২০ এর দশকে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের সহযোগী। দেশবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শ ছিল যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক আন্দোলনের পথে দেশ স্বাধীন। তারজন্য তিনি স্বরাজ দল গঠন করেন। যা সেময় ছিল সারা ভারতে কংগ্ৰেসের মতোই শক্তিশালী দল। কিন্তু ১৯২৫ সালে দেশবন্ধুর মৃত্যুর পর গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্ৰেস প্রধান শক্তিশালী দল হয়ে ওঠে।

গান্ধী ছিলেন অহিংসার আদর্শে বিশ্বাসী। এই পথেই দেশ স্বাধীন হবে বলে বিশ্বাস করতেন। ১৯৩০ এর পর থেকে কংগ্ৰেসের ভিতরেই একটি সমাজতান্ত্রিক গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে। সুভাষ ও জহরলাল ছিলেন এই গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।‌ ১৯৩৮ সালে সুভাষচন্দ্র কংগ্ৰেসের সভাপতি হলে এই আদর্শ নিয়ে গান্ধীর সঙ্গে মতো বিরোধ তীব্র হয়। অভিযোগ ওঠে সুভাষচন্দ্র কংগ্ৰেসকে অহিংসার পথ থেকে সহিংসার পথে নিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়াও যে জাতীয় কমিশন গঠন করেন তার পরিকল্পনার সঙ্গে গান্ধীর অর্থনৈতিক পরিকল্পনার বিরোধ দেখা দেয়।

আরও বড় অভিযোগ ছিল, সুভাষচন্দ্র কংগ্ৰেসের সভাপতি থাকাকালীন গোপনে দেশের ভিতর জার্মানির দূতাবাসের এক কর্মীর সঙ্গে দেখা করেন। গান্ধী, প্যাটেল, রাজেন্দ্রপ্রসাদ এরপর থেকে সুভাষের চরম বিরোধী হয়ে ওঠেন। ১৯৩৯ সালে গান্ধীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে পট্টভি সিতারামাইয়কে হারিয়ে দ্বিতীয় বার জাতীয় কংগ্ৰেসের সভাপতি হন। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হন পদত্যাগ করতে। এরপরই ১৯৪০ সালে ফরোয়ার্ড ব্লক গঠন করেন।

দেশ ছাড়েন ছদ্মবেশে ১৯৪১ সালে। কাবুল, রাশিয়া হয়ে জার্মানিতে পৌঁছান। কাবুলে সুভাষচন্দ্রের যিনি সঙ্গি ছিলেন, পরবর্তী ক্ষেত্রে জানা যায় তিনি ব্রিটিশের ডবল এজেন্ট গুপ্তচরে পরিণত হয়েছিলেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সাথে জাপান, বার্মা বা মায়ানমার দখল করে ভারতের সীমান্তে এসে পৌঁছালে জহরলাল নেহেরু জানান তিনি অস্ত্র দিয়ে জাপানের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন। কংগ্ৰেস কি তবে সহিংস পথে যাবে এই প্রশ্ন ওঠে সেই সময়। প্রশ্ন ওঠে সুভাষচন্দ্র যখন দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়ছেন তখন তাঁর বিরুদ্ধে জহরলালের অস্ত্র নিয়ে সুভাষের বিরুদ্ধে যাওয়ার কারণ কি!

আজাদ হিন্দ বাহিনীর লালকেল্লায় বিচারের পর, সুভাষ চন্দ্রের একনিষ্ট সহকর্মী ও আজাদ হিন্দ বাহিনীর ক্যাপ্টেন শাহনেওয়াজ খান জহরলালের ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন। শাহনেওয়াজ ও মুখার্জি কমিশনের রিপোর্টে এরপর বহু বিরোধীতা দেখা দেয়। ধামা পড়ে যায় আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিপুল সম্পত্তির তথ্য। পরবর্তী ক্ষেত্রে বহু তথ্য প্রকাশ হলেও প্রমাণিত হয়নি তাইহোকু বিমানবন্দরেই সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যুর ঘটেছিল। কারণ মৃতের তালিকায় সুভাষচন্দ্র বসুর নাম ছিল না।

সুভাষের মৃত্যুর পরেও জহরলাল নেহেরুর নির্দেশে সুভাষচন্দ্রের পরিবারের লোকদের ওপর দীর্ঘদিন ধরে কেন নজর রেখেছিল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা তাঁর উত্তর পাওয়া যায়নি। যা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন কংগ্ৰেসের দীর্ঘদিনের সাংসদ কৃষ্ণা বসু।

গুমনামী বাবা নিয়ে যে দীর্ঘ বিতর্ক তা একধরনের ষড়যন্ত্র বলেই মনে করছেন আধুনিক প্রচারবিদরা। কারণ গুমনামী বাবা নিয়ে যে আলোড়ন তা আসল সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক আদর্শকেই ভুলিয়ে দেওয়ার এক অপকৌশল মাত্র। কারণ গুমনামী বাবাকে কোনদিন মান্যতা দেয়নি নেতাজির পরিবার।

জাপান, বর্তমান রাশিয়া ও ভারতের ত্রিপাক্ষিক আলোচনা ও তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে সম্ভব ছিল নেতাজি রহস্য উদঘাটন। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। নেতাজি সম্পর্কিত দুটি অপ্রকাশিত তথ্য নেতাজির পরিবার জাপান থেকে আনার দাবি তুললেও ভারত সরকার এবিষয়ে আগ্ৰহ দেখায়নি। ১৯৫৬ তে তাইহোকু বিমানবন্দরে নেতাজির মৃত্যুর পক্ষে রায় দেয় জাপান সরকার। আমেরিকা ও ব্রিটেনের পৃথক তদন্তেও মেনে নেওয়া হয় নেতাজির মৃত্যুর কথা। যদিও তা বিশ্বাস যোগ্য বলে বিবেচিত হয়নি সব মহলে। এর আগেও সুভাষচন্দ্রের মৃত্যু হয়েছে বলে প্রচার হয়। কিন্তু পরে দেখা যায় তা ভুল।

কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদী ও রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নেতাজি সংক্রান্ত নানা ডিক্লাসিফাই তথ্য প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সেই তথ্যে এমন নতুন কোন তথ্য উঠে আসেনি যাতে প্রমাণিত হয় ১৯৪৫ সালে নেতাজি মারা গিয়েছিলেন।

তাহলে কি হয়েছিল নেতাজির? ভারতে মহাত্মা গান্ধী রাজনীতির বিপরীতে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। ভারতের অহিংস ভাবমূর্তির ধারণা গড়ার জন্যই কি মুছে দেওয়া হল নেতাজিকে? নেতাজির ধারণা এক বিকল্প ভারতের জন্ম দিত। সেই জন্যেই কি অমীমাংসিত থেকে গেল নেতাজির অন্তর্ধান রহস্য। এর সহজ উত্তর নেই। ভবিষ্যত ভারত হয়তো এর উত্তর দিতে পারবে।