আর্থিক অনটনে নয়, গানের নেশায়, সচেতনতার লক্ষ্যে ভাদু

লাল্টু : ‘ভাদু লে লে লে পয়সা দু আনা, কিনে খাবি মিছরির দানা।’ জনপ্রিয় এই ভাদু গান, কয়েকবছর আগে পর্যন্ত গেয়ে ও নেচে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত বেশ কিছু ভাদু শিল্পীদের ভাদ্র মাসে। কিন্তু বর্তমান মুঠোফোন, অত্যাধুনিক সাউন্ড সিস্টেম ইত্যাদির আঁড়ালে দুই দশক ধরে এই ভাদু গান এবং ভাদু শিল্পীরা লুপ্তপ্রায়। দেখা যায় না এই সকল ভাদু শিল্পীদের। অথচ কয়েক বছর বীরভূম, বাঁকুড়া, বর্ধমান, পুরুলিয়ার মত রাঢ় বাংলায় গ্রামে গ্রামে দেখা যেত ভাদু শিল্পীদের।

তবে বীরভূমে বেশকিছু গ্রামের সাধারণ দিনমজুর সম্প্রদায়ের মানুষ এই DJর যুগেও টিকিয়ে রেখেছেন এই ভাদু শিল্পকে। ভাদ্র মাসের পহেলা তারিখ থেকে একটি মেয়েকে ঘাগরার মত শাড়ি পরিয়ে ও মাথায় ওড়না দিয়ে ভাদু সাজিয়ে গানের সঙ্গে নাচানো চিরাচরিত রীতি। আর মাটির ভাদু মূর্তি কোলে করে নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে টাকা পয়সা আদায় করে ভাদু শিল্পীরা। ভাদু শিল্পীরা মুখে মুখে রচনা করেন গান, তাদের গানে উঠে আসে তাদের জীবন যন্ত্রণার প্রসঙ্গ, উঠে আসে সামাজিক বিষয়। ঢোল, হারমোনিয়াম, কাঁসা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র সহযোগে গান শোনান ভাদু গানের লোক শিল্পীরা।

এই ভাদু গানের পিছনে আছে এক রাজকুমারীর করুণ কাহিনী। পুরুলিয়ার কাশীপুরের পঞ্চকোটের রাজা নীলমণি সিং দেওরের কন্যা ছিল ভদ্রাবতী বা ভাদু। তাঁর বিবাহের ঠিক হয় বীরভৃমের এক রাজপুত্রের সঙ্গে। বিয়ের দিন বিবাহ করতে আসার পথে ডাকাতদলের হাতে খুন হন ভদ্রাবতীর হবু স্বামী।শোকে মুহ্যমান হয়ে ভদ্রাবতী আত্মঘাতী হয়। কারও মতে ভদ্রাবতী বা ভাদু চিতার আগুনে আত্মাহুতি দেয়। আবার কারো মতে জলে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুকে বেছে নেয়।রাজার প্রিয় ভদ্রাবতীকে জনমানসে স্মরণীয় করে রাখতে রাজা নীলমণি সিং দেওর ভাদু গানের প্রচলন করেন। ভাদু একটা লোকগান কিন্তু তার প্রচলন রাজপরিবারের হাত ধরে। আর তা শুরু হয় পয়লা ভাদ্র থেকে ভাদু পুজোর মধ্য দিয়ে।

বর্তমান এই অবলুপ্তির সময়ে যে সকল শিল্পীরা ভাদু গানকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টায় রয়েছেন তাঁদের মধ্যে আরও এক শিল্পী হলেন বীরভূমের খয়রাশোল ব্লকের নাকরাকোন্দা গ্রামের ভাদু শিল্পী ননী গোপাল দাস ও তাঁর সম্প্রদায় ‘জয়গুরু সম্প্রদায়’। তিনি আর্থিক অনটনে এই ভাদু গান করেন এমনটা নয়, তিনি এই ভাদুর গানকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন কেবলমাত্র গান বাঁধার নেশায় এবং সমাজ সচেতনতামূলক বার্তা সাধারণ মানুষদের কাছে তুলে ধরার জন্য। ভাদু গান হল লোকগান, তাই এই গানের মাধ্যমে গ্রাম্য মানুষের কাছে সচেতনতামূলক বার্তা পৌঁছে দেওয়া সব থেকে বেশি সহজ।

তাঁর সাথে কথা বলে জানা গিয়েছে, তিনি সারা বছর ধরে গান রচনা করেন এবং ভাদ্র মাসে গ্রামে গ্রামে গিয়ে ঘুরে বেড়ান, ছড়িয়ে দেন ভাদু গান। তাঁর ভাদু গানের মধ্যে ফুটে ওঠে জল অপচয় বন্ধ করার বার্তা, গাছ লাগানোর বার্তা, প্লাস্টিক বর্জন করার বার্তা, নেশামুক্ত সমাজ গড়ে তোলার বার্তা, বাল্যবিবাহ বন্ধ করার মত নানান সামাজিক সচেতনতামূলক বার্তা।

তিনি এই ভাদু গান গেয়ে বেড়ান এ রাজ্যের বীরভূম, বর্ধমান, পাণ্ডবেশ্বরের মত এলাকায়। শুধু এরাজ্যেই নয়, তিনি ছুটে যান পার্শ্ববর্তী রাজ্য বিহার এবং ঝাড়খন্ডেও।

তবে তাঁর কথায় যেমন ফুটে ওঠে সামাজিক সচেতনতামূলক বার্তা, যেমন গান বাঁধার তাগিদে ভাদুকে আঁকড়ে ধরে রাখার কথা, পাশাপাশি তাঁর কথাতেই রয়েছে আক্ষেপ। তিনি জানান, “গ্রামগঞ্জে এখনো পর্যন্ত ভাদু গানের চাহিদা থাকলেও রোজগার বলতে সামান্যটুকু। আর এই ঐতিহ্যবাহী ভাদুকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে অবশ্যই সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন।”