১২৪০ থেকে দশম উত্তরসূরীর হাত ধরে ডাকের সাজে হেতমপুর রাজবাড়ীর দুর্গা প্রতিমা

লাল্টু : বীরভূমের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী স্থান হেতমপুর রাজবাড়ী, যে রাজবাড়ী বীরভূমের হাজারদুয়ারি নামেও পরিচিত। এই রাজবাড়ীকে কেন্দ্র করে ইতিহাসের পাতা ধরে বয়ে গেছে বহু তরঙ্গ, তা সত্ত্বেও ঐতিহ্যবাহী প্রথাকে আঁকড়ে ধরে আছে রাজবাড়ির উত্তরসূরিরা।

আর মাত্র কয়েকটা দিন বাঙালির শ্রেষ্ঠ পুজো, দুর্গাপূজার। ঢাকে কাঠি ইতিমধ্যেই পড়ে গেছে, কাশফুল, শিউলি, পেঁজাতুলোর মতো শরতের মেঘ বলতে শুরু করেছে মা আসছেন। দিকে দিকে সেজে উঠেছে মণ্ডপ, শুরু হয়েছে তোড়জোড়। তাহলে ঐতিহ্যবাহী হেতমপুর রাজবাড়ীর দুর্গাপূজা! সেখানে কতটা ব্যস্ততা তা দেখতেই রাজবাড়ীতে পা রাখা আমাদের প্রতিনিধির।

গিয়ে দেখতেই পাওয়া গেল অন্যান্য জায়গার মতো সেখানে পড়েছে তোড়জোড়। আর তারই মাঝে হেতমপুর রাজবাড়ির রাজকন্যা বৈশাখী চক্রবর্তী এই ঐতিহ্যবাহী পুজোর শোনালেন ঐতিহাসিক কাহিনী।

তিনি জানান, “বাংলার ১২৪০ সালে আমাদের বংশের তৃতীয় উত্তরসূরি রাধানাথ চক্রবর্তীর পুত্র গঙ্গানারায়ণ চক্রবর্তী এই পূজার প্রচলন করেন। সে সময় তিনি এই পুজো শুরু করার প্রচেষ্টা করেন। এই পুজোর সমস্ত ব্যবস্থাপনা করার কিছুদিনের মধ্যেই তিনি মারা যান। ফলে এই দুর্গাপুজোর উদ্যোগ নিলেও তাঁর পক্ষে এই পুজো করা সম্ভব হয়নি। রাধানাথ চক্রবর্তী এই দুর্গা মন্দির প্রতিষ্ঠা করে তার মেয়ে রুক্মিণী দেবী অর্থাৎ গঙ্গানারায়ণ চক্রবর্তীর বোনের নামে পুজো শুরু করেন। যদিও সমস্ত খরচ বহন করা হয় রাজবাড়ী থেকে। রুক্মিণী দেবী মুন্সেফ বাড়ির বউ, সে কারণে ওনাকে মুন্সেফ ঠাকুরানী বলা হত। তাই এই পুজো অনেকের কাছে মুন্সেফ ঠাকুরানীর পুজো নামেও পরিচিত।”

একসময় এই পূজাকে ঘিরে বৃহৎ আয়োজনের ব্যবস্থা ছিল। গ্রামগঞ্জ থেকে আসা মানুষদের দানের ব্যবস্থা ছিল এই পূজাকে কেন্দ্র করে। পুজোতে চারদিন পেটপুরে খাওয়ানো হতো স্থানীয়দের। পাশাপাশি টপ্পা, নাটক, যাত্রা ইত্যাদি নানান সামাজিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সুযোগ হয়েছিল এলাহি ব্যাপার। তবে বর্তমানে সেসব জৌলুস হারালেও রাজবাড়ীর দুর্গাপুজোর ঐতিহ্য আছে একরকম।

এ বছর ১৮৫ তম বর্ষে এই দুর্গাপুজোর দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন রাজবাড়ী দশম উত্তরসুরি বিশ্বরঞ্জন চক্রবর্তীর নাতনি বৈশাখী চক্রবর্তী। পুজোর দায়িত্বভার নিয়েই তিনি এবারের পূজোতে কিছুটা হলেও অভিনবত্ব আনার চেষ্টা করেছেন। তিনি জানান, “এবছর প্রথম আমি দুর্গা প্রতিমাকে ডাকের সাজে সাজাতে চলেছি।” পাশাপাশি তিনি এও জানান, “দুর্গা প্রতিমার সাজের ক্ষেত্রে পরিবর্তন হলেও শতাধিক বছরের ঐতিহ্যবাহী পুজোর কোথায় কোন পরিবর্তন আনা হবে না। প্রাচীন ঐতিহ্য মেনেই পুজো দেওয়া হবে, বংশ পরম্পরার ঐতিহ্য মেনেই রক্তহীন অর্থাৎ কোনরকম প্রাণ বলি ছাড়াই এই পুজো হবে। তবেই রীতি মেনে সপ্তমী, অষ্টমী এবং নবমীর দিন মন্ডা বলি দেওয়া হবে।”

প্রসঙ্গত, বিগত ১০ বছর এই দুর্গাপুজো একপ্রকার বিলীন হয়ে গিয়েছিল বলাই বাহুল্য। কারণ এই দীর্ঘ সময় রাজকন্যা বৈশাখী চক্রবর্তীর পিতার অসুস্থতার কারণে এই পুজোর দায়িত্বে যারা ছিলেন তারা ছোটখাটো করে পূজো পরিচালনা করে এসেছিলেন। ফলো তো বলা যাই, ১০ বছর পর আবার নতুন করে রাজকন্যা বৈশাখী চক্রবর্তীর হাত ধরে স্বমহিমায় হেতমপুর রাজবাড়ী সুপ্রাচীন দুর্গাপুজো।