টানা ৩০ দিনের লকডাউনে ভারত করোনা সংক্রমণ আটকাতে কতটা সফল

নিজস্ব প্রতিবেদন : বিশ্বের পাশাপাশি ভারতেও করোনা ভাইরাসের টের পাওয়া যেতে শুরু করে মার্চ মাসের শুরুতে। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে সংক্রমণ। পরিস্থিতি খুব একটা নাগালের বাইরে যাওয়ার আগেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দেশে জারি করেন লকডাউন। মার্চ মাসের ২৪ তারিখ থেকে শুরু হয় লকডাউন। পরে তা আবারও বাড়ানো হয়। আর দেখতে দেখতে এই লকডাউন অতিক্রম করে ফেলল ৩০ টা দিন। কিন্তু টানা এই ৩০ দিনের লকডাউনে ভারত কোন জায়গায় এসে দাঁড়ালো? সংক্রমণ কতটা আটকাতে পারলো এই লকডাউন।

ভারতে প্রথম করোনা সংক্রামিত রোগীর খোঁজ পাওয়া যায় জানুয়ারি মাসে। প্রথম যে ব্যক্তির শরীরে করোনা ধরা পড়েছিল তিনি বিদেশ ফেরত কেরলের বাসিন্দা। এরপর ফেব্রুয়ারি মাসে করোনা ভারতের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায় নি। মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াতে শুরু করে মার্চ মাসের প্রথমদিকে। যখন দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে খবর আসে করনা সংক্রামিত রোগীর।

যেদিন দেশে লকডাউন জারি হয় সেদিন মোট সংক্রামিত রোগীর সংখ্যা ছিল ৬১৯। যাদের মধ্যে মৃতের সংখ্যা ছিল ১৩। আর আজ সেই জায়গাটা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে! আজ গোটা দেশে সংক্রামিত রোগীর সংখ্যা ২৪৯৪২ আর মৃতের সংখ্যা ৭৭৯। তবে আশার আলো এটাই, সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৫২১০ জন।

লকডাউন যেদিন শুরুর সময় মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক, দিল্লি, পাঞ্জাব, গুজরাত, পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু, হিমাচল প্রদেশ, বিহার এসব রাজ্যে মৃতের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা একজন করে। মহারাষ্ট্রে তখন সংখ্যাটা ছিল কিছুটা বেশি ৩। আর বর্তমানে এই পরিসংখ্যানটা বেড়েছে হু হু করে।

লকডাউন শুরুর দিন থেকে কেরলে সংক্রমণ ছিল ১১২, যা আজ ৪৫১। পাঞ্জাবে ছিল ২৯, বর্তমানে তা ২৯৮। দিল্লিতে ছিল ৩০ জন, বর্তমানে সংখ্যাটা পৌঁছেছে ২৫১৪। জম্মু-কাশ্মীরে ১১ জন থেকে সংখ্যাটা পৌঁছেছে ৪৫৪ জনে। লাদাখে ১৩ জন থেকে সংখ্যাটা পৌঁছেছে ২০ তে। রাজস্থানে সংখ্যাটা ছিল ৩৬ জন, কিন্তু বর্তমানে তা পৌঁছে গেছে ২০৩৪-এ। উত্তরপ্রদেশে সংখ্যা ছিল ৩৮, তা এখন ১৭৭৮। মহারাষ্ট্র ছিল ৩৮, কিন্তু এই রাজ্য এখন সব থেকে বেশি সংক্রামিত রোগী নিয়ে বসবাস করছে, সংখ্যাটা হলো ৬৮১৭। কর্নাটকে ৫১ থেকে ৪৮৯, তামিলনাড়ু ২৬ থেকে ১৭৫৫, তেলেঙ্গানা ৩৯ থেকে ৯৮৪, হরিয়ানা ২১ থেকে ২৭২, হিমাচল প্রদেশ ৪ থেকে ৪০, অন্ধ্রপ্রদেশ ১০ থেকে ১০৬১, গুজরাট ৩৮ থেকে ২৮১৫, উত্তরাখণ্ড ৪ থেকে ৪৮, ওড়িসা ২ থেকে ৯৪, পশ্চিমবঙ্গ ১০ থেকে ৫৭১, চন্ডিগড় ৭ থেকে ২৮, ছত্রিশগড় ৩ থেকে ৩৬, মধ্যপ্রদেশ ১৮ থেকে ১৯৫২, বিহার ৫ থেকে ২২৮, পুদুচেরি ১ থেকে ৭।

অর্থাৎ লকডাউন জারি থাকলেও সংক্রামিতদের সংখ্যাটা মোটেই কমেনি। বরং তা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। তবে এখানে আশার আলো এটাই যে এই লকডাউনের মাঝেই ৪ রাজ্য করোনা মুক্ত হয়েছে। প্রথম হলো গোয়া, দ্বিতীয় মনিপুর, অরুণাচল প্রদেশ ও ত্রিপুরা। আর করোনা ছুঁতে পারেনি এমন রাজ্যগুলি হল দমন ও দিউ, লাক্ষাদ্বীপ, দাদরা ও নগর হাভেলি, সিকিম ও নাগাল্যান্ড।

এবার প্রশ্ন তাহলে এই টানা ৩০ দিন লকডাউন চালানোর পর ভারত কি সফলতা পেল?

পরিসংখ্যান সংক্রমণের গ্রাফ বাড়া দেখলেও বা সংক্রমণ বাড়লেও কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিক সময়ে যদি ভারতে লকডাউন জারিনা হতো তাহলে আজ যেখানে সংক্রমণের সংখ্যাটা যেখানে ২৪৯৪২তে এসে পৌঁছেছে সেই সংখ্যাটা টপকে যেতে পারতো আমেরিকার থেকেও বেশি। আর মৃতের সংখ্যা যেখানে এখনো হাজার টপকায় নি তা পৌঁছে যেতে পারত কয়েক হাজার বার লাখে। বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও ভারতের সঠিক সময় লকডাউনের পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানিয়েছে। যে কারণেই দেশের প্রতিটি রাজ্য, প্রতিটি মানুষ শত কষ্ট সহ্য করেও এই লকডাউনকে স্বাগত জানিয়েছে।

দেশে সঠিক সময়ে লকডাউন জারি না হলে সংক্রমণ ও মৃতের সংখ্যাটা পৌঁছে যেত বিশ্বের সব দেশকে টপকে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞরা যে যুক্তি দিয়েছেন তা হল, ভারতের জনঘনত্ব, যা আমেরিকা অথবা ইতালির তুলনায় অনেক বেশি। এছাড়াও ইটালি ও আমেরিকাতে চিকিৎসা ব্যবস্থা ভারতের তুলনায় অনেক উন্নত। সেখানে সংক্রামিত ব্যক্তিদের হাসপাতালে জায়গা দিতে না পেরে মরতে হচ্ছে, সুতরাং এই পরিস্থিতি ভারতে হলে কি হতো বা হবে তা কল্পনাতীত।

এছাড়াও যদি সফলতা বা সুফল ও তার বিচার করা হয় তাহলে এটাই বলতে হবে যে, সংক্রমণ ঠেকানোর বিচারে ভারত বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেকটা এগিয়ে রয়েছে। আর্থিক দিক দিয়ে বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন দেশ, আর এই বোঝা দেশকে আগামী কত বছর বইতে হবে তার ঠিক ঠিকানা নেই।পাশাপাশি দেশের নাগরিকদের অফুরন্ত কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে বা হচ্ছে এই কয়েকটা দিন। সবথেকে বেশি কষ্টের মধ্যে রয়েছেন দেশের দীন দরিদ্র মানুষেরা, সবথেকে বেশি কষ্টে যারা চিকিৎসা অথবা শ্রমিকের কাজ করতে গিয়ে ভিন রাজ্যে আটকে পড়েছেন। তবে এসব সত্ত্বেও সবকিছুকে সহ্য করে দেশের জন্য করোনা স্বাধীনতার লড়াইয়ে এটুকুই আমাদের আত্ম বলিদান। আমরাও একদিন ভবিষ্যতে বলতে পারব করোনা থেকে দেশকে বাঁচাতে আমরা এই ভাবে নিজেদের আত্মত্যাগ করেছিলাম।