মহাভারতের ৮টি বিষয় জীবনে সফল হওয়ার রাস্তা দেখায়

Sangita Chowdhury

Updated on:

Advertisements

নিজস্ব প্রতিবেদন : মহর্ষি বেদব্যাস রচিত ‘মহাভারত’ এমন একটি গ্রন্থ যা যুগ যুগ ধরে মানুষকে সঠিক পথে চলার সন্ধান দিয়েছে। মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণের মুখ থেকে উৎসারিত ‘গীতা’ একটি দর্শন। কিন্তু শুধু গীতাই নয় সমগ্র মহাভারতের প্রতিটি চরিত্রই আমাদের কিছু না কিছু শিক্ষা দেয়। চরিত্রগুলি বিচার করলে আমরা সামগ্রিক জীবন যাপনের কতগুলি শিক্ষা পায়।

Advertisements

মহাভারতের থেকে পাওয়া এই শিক্ষণীয় বিষয়গুলি হল-

Advertisements

১) অন্ধ অনুকরণ ভালো নয় : কোন কিছুরই অন্ধ অনুকরণ যে ভালো নয় সেই শিক্ষা মহাভারত আমাদের দিয়েছে।মহাভারতের ভীষ্ম চরিত্রটি আলোচনা করলেই আমরা সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারি। মহাভারতের ভীষ্ম পিতা শান্তনুর সঙ্গে সত্যবতীর বিবাহ দেওয়ার জন্য ব্রহ্মচর্যের ও একজন দাসের মত জীবন পালনের প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। কিন্তু তখন তিনি ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। পরবর্তীকালে যখন সত্যবতীর দুই সন্তান মারা যান, তখন সত্যবতী অনুরোধ করলেও তিনি নিজের প্রতিজ্ঞা থেকে সরে আসেননি। আবার দ্রোপদীর বস্ত্র হরণের সময়ও তিনি বাধা দান করেন নি। তিনি চাইলেই মহাভারতের এই বিশাল যুদ্ধ থামাতে পারতেন। কিন্তু নিজের প্রতিঞ্জাকে পূরণ করতে গিয়ে তিনি অনিচ্ছাসত্ত্বেও কৌরব পক্ষে যোগ দিয়েছিলেন, আর তার এই যোগদানই কৌরবদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছিল কয়েকগুণ। ভীষ্ম নিজের সমগ্র জীবন ব্যাপী নিজের প্রতিজ্ঞাকে রক্ষা করতে গিয়ে অনেক অধর্ম মুখ বুজে সহ্য করেছেন যা মহাভারতের প্রেক্ষাপট রচনা করেছে। তাই আমাদের উচিত যে পরিস্থিতি সাপেক্ষে জীবন চালনা করা। পূর্ববর্তী কোন প্রতিজ্ঞা যদি ভবিষ্যতে ভাঙ্গার প্রয়োজন হয়, তাহলে তা অবশ্যই ভাঙতে হবে। কারণ কুলক্ষয়কারী যুদ্ধকে আটকাতে সামগ্রিক হিতের জন্য করণীয় সবকিছুই মঙ্গলময়।

Advertisements

২) ন্যায় অন্যায়ের ফারাক : পরিস্থিতি যায় আসুক না কেন সব সময় ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো উচিত। কারণ সত্য এবং ন্যায়ই পরিশেষে জয়লাভ করে আর অসত্য ও অন্যায় চিরতরে মুছে যায়। তাই পান্ডবদের সেনার তুলনায় কৌরব সেনা বহুগুণ হওয়া সত্ত্বেও কৌরব সেনার বিনাশ হয়েছিল কেবলমাত্র অধর্ম ও অন্যায়ের কারণে। ভীষ্ম, কর্ণ, দ্রোণ প্রভৃতি রথী-মহারথীদেরও বিনাশ হয়েছিল অধর্মের সঙ্গ দেওয়ার জন্য।

৩) জন্মের তুলনায় কর্ম বেশি গুরুত্বপূর্ণ : মহাভারতে শুদ্র বংশজাত হওয়ার কারণে কর্ণকে অনেক অপমান সহ্য করতে হয়েছিল। যদিও কর্ণ নিজের বীরত্বের দ্বারা বারংবার ক্ষত্রিয়সুলভ ক্ষমতার প্রদর্শন করেছিল। তবুও তাকে অপমানিত হতে হয়েছে আর এই অপমান পান্ডব পক্ষের মধ্যে যুধিষ্ঠির ব্যতিরেক সকলেই করেছিলেন। কিন্তু পরিশেষে যখন জানা গেল যে কর্ণ তাদেরই অগ্রজ তখন তাদের আফসোসের শেষ থাকলো না। তাই কর্মই মানুষের যোগ্যতার শেষ মাপকাঠি হওয়া উচিত। আর কর্মই যে মানুষের যোগ্যতার শেষ মাপকাঠি হয় সে শিক্ষা ও মহাভারত আমাদের দিয়েছে। তাই পরিশেষে কর্ণ দানের কারণে ও বীরত্বের কারণে দানবীর ও মহাবীর রূপেই পরিচিত।

৪) ভাবনা-চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া : মহাভারতের শেষে সবথেকে বেশি মনস্তাপ করতে হয়েছিল ভীষ্ম ও ধৃতরাষ্ট্রকে। কারণ ভীষ্ম বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি চাইলেই এই যুদ্ধ থামাতে পারেন। আবার ধৃতরাষ্ট্রও নিজেকে দায়ী করেছিলেন যে তিনি অন্ধ পুত্র-স্নেহের বশে পান্ডবদের প্রতি অন্যায় না করলে এমন যুদ্ধ হতো না। কিন্তু সময় পেরিয়ে গেলে কোন আফসোসেরই কোন মূল্য থাকে না। তাই সঠিক সময় থাকতে ভাবনা চিন্তা করে প্রত্যেকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। কারণ যেকোন সিদ্ধান্তই ভবিষ্যতের জন্য একটি কর্মফল প্রদান করে। ন্যায় ও সৎ সিদ্ধান্ত সাময়িক কষ্ট দিলেও ভবিষ্যতে সুখকর ফল প্রদান করেন আর অন্যায় ও অসৎ সিদ্ধান্ত সাময়িক সুখ দিলে ও ভবিষ্যতে ভয়াবহ পরিণামের মুখে দাঁড় করায়।

৫) অর্ধশিক্ষা ভয়ঙ্কর : কর্ণের মত বীর ধনুর্ধর ও মহাভারতের যুদ্ধে হেরে গিয়েছিলেন শুধুমাত্র তার মন্ত্র ভূলে যাওয়ার কারণে আবার অভিমুন্য ও পরাস্ত হয়েছিলেন শুধুমাত্র অর্ধ শিক্ষার কারণে। অভিমন্যু চক্রব্যূহে প্রবেশের পথ জানতেন কিন্তু প্রস্থানের পথ জানতেন না। মহাভারত তাই শিক্ষা দেয় যে কোন শিক্ষায় সম্পূর্ণ হওয়া উচিত। অর্ধশিক্ষা কখনোই বিপদে কাজে লাগে না।

৬) অর্ধসত্য মিথ্যার চাইতেও ভয়ংকর : মহাভারতে যুধিষ্ঠির আজীবন সত্য কথা বলেছিলেন বলে তার রথের চাকা সব সময় মাটির থেকে চার আঙ্গুল উঁচুতে থাকতো। একমাত্র মহাভারতের যুদ্ধের সময় তিনি দ্রোণাচার্যের হাত থেকে অস্ত্র ফেলে দেওয়ার জন্য বলেছিলেন ‘অশ্বত্থামা হত’। এই অশ্বত্থামা আসলে একটি হাতি ছিল।কিন্তু দ্রোণ ভেবেছিলেন তার পুত্র অশ্বত্থামা মারা গেছেন। ফলস্বরূপ তিনি অস্ত্র ত্যাগ করেন। যুধিষ্ঠির শুধুমাত্র এই অর্ধসত্য বলার জন্যই তার রথের চাকা মাটিতে পড়ে যায়। আর সারা জীবন সত্য ও ধর্ম পথে চলার জন্য সশরীরে স্বর্গ লাভ করলেও শুধুমাত্র এই অর্ধসত্যের কারণেই যুধিষ্ঠিরকে এক মুহূর্তের জন্য হলেও নরক দর্শন করতে হয়েছিল।

৭) ধর্ম স্থাপনের জন্য, ন্যায় প্রদানের জন্য ছলনা ও শ্রেয় : যুধিষ্ঠির ছলনার আশ্রয় নিয়েছিলেন দ্রোণ বধের সময়। আবার কর্ণকে বধ করবার জন্য ছলনার আশ্রয় নিয়েছিলেন অর্জুনও। আর এই সকল ছলনা করতে উৎসাহিত করে ছিলেন স্বয়ং কৃষ্ণ যিনি স্বয়ং ভগবান বিষ্ণুর অবতার। এর মধ্য দিয়ে এই শিক্ষাই পাওয়া যায় যে, অধর্মকে পরাস্ত করবার জন্য সত্যকেও ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করবার জন্য কখনো কখনো ছলনার আশ্রয় নিতে হয়। ঠিক যেমন আদালতে সত্যকে সত্য বলে প্রমাণ করবার জন্য উকিলকে অনেক সময় অপরাধীকে নানারকম বিভ্রান্ত করে, মানসিকভাবে মনস্তাপ দিয়ে সত্য প্রতিষ্ঠা করতে হয়। কিন্তু তা বলে এই ছলনা অপরাধ নয়। যখনই কোনো কাজ সত্যের জন্য ধর্মের জন্য করা হবে তখনই তা ধর্ম যুদ্ধ আর যখনই কোন ছলনা অধর্ম অন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করার জন্য করা হবে তখনই তা অধর্ম। আসলে কোন কাজ কী উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে সেটাই সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর কাজের উদ্দেশ্য বুঝেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।

৮) নিজ বুদ্ধিকে কাজে লাগানো : মহাভারতে কৌরব পক্ষের মধ্যে দুঃশাসনের মৃত্যু সবথেকে বেশি ভয়াবহ হয়েছিল। ভীম তার ছাতি চিরে রক্তপান করেছিলেন। মহাভারতে দুঃশাসনের এই ভয়াবহ মৃত্যুর কারণ ছিল সে কোনো দিনই নিজের বিদ্যা বুদ্ধিকে কাজে লাগায়নি। বরাবর সে দুর্যোধনের কথা শুনে এসেছে। নিজের বিদ্যা বুদ্ধিকে কাজে না লাগিয়ে অন্যের কথায় বশবর্তী হয়ে চিরকাল সে অধর্ম করেছে। তাই মৃত্যু ছিল অসহ্য যন্ত্রণা কর। অপরদিকে কৌরবপক্ষের একজন দ্রোপদীর বস্ত্রহরণের প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেছিলেন। অধর্মের সঙ্গ দেওয়ার জন্য তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ভীম তাকে স্বাভাবিক মৃত্যু দিয়েছিলেন, কম যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু দিয়েছিলেন।

তাই পরিশেষে মহাভারত আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে জীবনে যে কোনো পরিস্থিতিতে সত্য, ন্যায় ও ধর্ম পথে চলা উচিত। সত্য, ন্যায় ও ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ছলনার আশ্রয় ও শ্রেয়। যেকোনো সিদ্ধান্ত সব সময় ভাবনা-চিন্তা করে নেওয়া উচিত। জন্মের জন্য নয়, কর্মের জন্য যোগ্যতার জন্যই মানুষ সম্মান অর্জন করেন। অর্ধ শিক্ষা সবসময়ই ভয়ঙ্কর আর কখনোই কোন মানুষের অন্ধ অনুকরণ করা উচিত নয়। সব সময় পরিস্থিতি বিচার করেই মানুষের চলা উচিত। কোন কিছুকেই অন্ধের মতো আঁকড়ে ধরা উচিত নয়। প্রতিমুহূর্তে মানুষের বেঁচে থাকার পথ, মানুষের পূর্ববর্তী কথা, পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করা উচিত আর জীবনের ও পরিস্থিতির সাপেক্ষেই তার বদল করা উচিত।

Advertisements