বাংলার গর্ব বটুকেশ্বর দত্তকে কতটুকু চেনেন? জানুন এক অজানা ইতিহাস

নিজস্ব প্রতিবেদন : স্বাধীন ভারতের যে স্বাধীনতা সংগ্রামী পাননি সম্মানটুকু, সেই মহান ব্যক্তি ফিরছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর হাত ধরে। ১৯৬৫ সালের ২০ জুলাই লোকচক্ষুর আড়ালে এই মহান ব্যক্তিত্ব ইহলোক ত্যাগ করে গমন করেন পরলোকে।

৮ ই এপ্রিল ১৯২৯ সাল, তৎকালীন ইম্পিরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের হলে হঠাৎ জোড়া বিস্ফোরণ। বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে গোটা হল। হলের মধ্যে থাকা সকলের প্রাণ বাঁচানোর জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করে। হঠাৎ দর্শক আসন থেকে উঠে আসে দুই অকুতোভয় যুব সোচ্চার ধ্বনি শুরু করেন ‘ইনক্লাব জিন্দাবাদ’, ‘নিপাত যাক সাম্রাজ্যবাদ’।

ওই দুই অকুতোভয় যুবকের মধ্যে একজনকে আমরা সকলেই চিনি, তিনি হলেন ভগৎ সিং। কিন্তু আরেকজন? তিনি হারিয়ে গেছেন ইতিহাসের পাতায়। অথচ তিনি একজন বঙ্গসন্তান, তিনি বর্ধমানের সন্তান। শুধু তাই নয়, স্বাধীন ভারতে জীবিত থেকেও সেভাবে সম্মান জোটেনি তাঁর কপালে। ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে বাংলার গর্বের সেই বঙ্গসন্তান বটুকেশ্বর দত্তকে। তবে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দেওয়ার এই কাজ ইচ্ছাকৃত, না অনিচ্ছাকৃত দা বিস্তর বিতর্কের। তবে সেই মহান বিপ্লবী বটুকেশ্বর দত্তই আবার ফিরতে চলেছেন বঙ্গে। তিনি ফিরতে চলেছেন ইতিহাসের পাতা থেকে বর্তমানে। দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর হাত ধরে স্বাধীনতা সংগ্রামী বটুকেশ্বর দত্তের নামে বর্ধমান স্টেশনের নামকরণের সিদ্ধান্ত।

১৮ ই নভেম্বর ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমানে জন্মগ্রহণ করেন এই মহান বিপ্লবী বটুকেশ্বর দত্ত। ছোটবেলার পড়াশুনা এবং শৈশব বাংলায় কাটানোর পর তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য চলে যান কানপুরে। সেখান থেকে তিনি হোন স্নাতক। আর সেই কানপুরেই ভগৎ সিংয়ের সঙ্গে আলাপ হয় বটুকেশ্বর দত্তের। তারপর ভগৎ সিং এবং অজয় ঘোষের সঙ্গে তিনি সদস্যপদ গ্রহণ করেন হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের। পরে যুক্ত হন হিন্দুস্তান সোস্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের সাথে। বোমা বাঁধায় দক্ষ যতীন্দ্রনাথ দাসকে সংগঠনে এনেছিলেন বটুকেশ্বর দত্তই।

তৎকালীন দিল্লির কেন্দ্রীয় সংসদে পাবলিক সেফটি এবং ট্রেড ডিসপুট বিল পেশ হওয়ার কথা ছিল। আর এই দুটি বিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য সংসদে হামলার পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু সেই হামলা চালাবে কে? সংগঠনের তরফ থেকে হামলা চালানোর জন্য বেছে নেওয়া হয় দুজনকে, একজন হলেন ভগৎ সিং এবং দ্বিতীয় জন বটুকেশ্বর দত্ত। চয়ন করা মাত্রই এই দুই যুবক হামলা চালায় সংসদে। সংসদে হামলা চালানোর পর অকুতোভয় এই দুই বিপ্লবী নিজেদের আসন থেকে সরে যাননি। বরং সেখানে দাঁড়িয়েই বন্দনা করেছিলেন দেশমাতৃকার। তাদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল গোটা সংসদ ইনক্লাব জিন্দাবাদ ধ্বনিতে। সংসদের মধ্যে থাকা কাগজ উড়িয়ে দিয়েছিলেন। ব্রিটিশ পুলিশ সামনে আসা সত্ত্বেও এতোটুকু ভীত হননি তাঁরা। আর তারপরই গ্রেফতার করা হয় তাঁদের দুজনকে।

কিন্তু সে সময় ব্রিটিশ সরকারের কাছে আতঙ্কের কারণ ছিল বাঙালি। ভয় তাকে জেলে রাখতে পারেননি। সাজা হয় কালাপানি জেলের। বটুকেশ্বরকে স্থানান্তরিত করা হয় আন্দামানের সেলুলার জেলে। লাহোর বিস্ফোরণ মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে পোক্ত প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

Source

দেশের জন্য লড়াই করা এই বটুকেশ্বর দত্ত দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও সেভাবে সম্মান পাননি। ভারত স্বাধীনতা লাভের পর তৎকালীন সরকার সম্মানজনক কোন চাকরিও তাঁকে দেননি। অঞ্জলি নামে এক মহিলাকে বিবাহ করেছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে প্রচণ্ড অভাব অনটনের মধ্যে কাটে তাঁর জীবন। পাউরুটি বিক্রি করে এবং পরিবহনের ব্যবসায় হাত পাকানোর চেষ্টা করলেই সফল হননি তিনি।

পরবর্তীকালে যক্ষা রোগ ধরা পড়ে তার শরীরে। বিহারের পাটনা হাসপাতালে অসহায় ভাবে শত কষ্টের মধ্যে চিকিৎসা চলে তার। আর সে সময় পার্টনার এক সাংবাদিকের খবরে টনক নড়ে তৎকালীন সরকারের। সেই সাংবাদিক লিখেছিলেন, ‘বটুকেশ্বর দত্তের মতো বিপ্লবী এদেশে জন্ম নেওয়াই বৃথা। ঈশ্বর ভুল করেছে’। সেই খবরে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায় দেশজুড়ে। তারপর তার সঙ্গে দেখা করেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গুলজারিলাল নন্দা। চিকিৎসার ক্ষেত্রে পাঞ্জাব সরকারের তরফ থেকে আসে অর্থ সাহায্য। কিন্তু এরপরে আবার তার শরীরে ধরা পড়ে ক্যান্সার। তারপর তাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় দিল্লিতে।

কিন্তু নিয়তির বিধানকে কি কেউ আটকাতে পারে? ১৯৬৫ সালের ২০ জুলাই লোক চক্ষুর আড়ালে মৃত্যু হয় বটুকেশ্বর দত্তের। বটুকেশ্বর দত্তের শেষ ইচ্ছা ছিল ভগৎ সিং এবং রাজগুরুর পাশে যেন তাঁকে সমাধিত করা হয়। আর সেই শেষ ইচ্ছা মতই পিরোজপুরে ভগৎ সিং এবং রাজগুরুর পাশে তাঁকে সমাধিত করা হয়।