সুকেশ মণ্ডল : সুপুরের সাথে জড়িয়ে আছে এক বিখ্যাত মানুষ আনন্দচাঁদ গোস্বামী। বলা যেতে পারে তিনি সুপুরের কিংবদন্তী নায়ক। বলিষ্ঠ, দৃঢ়কায়, গৌরবর্ণ এমন সব বৈশিষ্ট্যই তাঁর মধ্যে ছিল, যা একজন সুপুরুষ বা সাধু পুরুষের থাকা দরকার। তিনি ছিলেন শ্যামচাঁদ বা শ্যামসুন্দর জিউ (ভগবান শ্রী কৃষ্ণ)-এর পরম উপাসক৷ তাঁর প্রতিষ্ঠিত সে সময়কার মন্দির আজও দু-একটি অক্ষত আছে। এখানে ছিল তাঁর আশ্রম, যাকে তখনকার দিনে বৃন্দাবনের সমতুল্য হিসেবে সমাদৃত করা হত।
বৃন্দাবনের অনুকরণে তিনি তৈরি করিয়েছিলেন যমুনা-পুলিন, দ্বাদশ-বন, গিরিগোবর্ধন, রাস-মঞ্চ, দোল-মঞ্চ, ঝুলন-মঞ্চ ইত্যাদি৷ খেঁজুর গাছে ঘিরে থাকা ভগ্ন প্রায় মন্দির আর ইটের সিঁড়ি বাঁধানো পুকুর আজও তার উপস্থিতির কথা জানান দেয়৷ মহাপ্রভু চৈতন্যদেব বক্রেশ্বর থেকে অজয় উপত্যকা বরাবর পথ ধরে কাটোয়া হয়ে শান্তিপুর যান। এই সময় তিনি সুপুর এসেছিলেন, সালটা তখন ১৫১০ খ্রিষ্টাব্দ। তাঁর বীরভূম পরিক্রমের দরুন এখানে বৈষ্ণবদের সাধনা ও ভক্তিবাদের সূত্রপাত ঘটে। পরবর্তীকালে সুপুর বৈষ্ণবদের বিচরণক্ষেত্র হয়ে ওঠে। আনন্দচাঁদ ছিলেন বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মাথার মনি৷ আনন্দচাঁদকে তারা ভগবান প্রেরিত দূতের ন্যায় সম্মান করতেন৷
এ অঞ্চলের গৃহস্থ বৈষ্ণবদের যারা সন্তানহীন বা কাছের বলে আর কেউ নেই, মৃত্যুর পর তাঁদের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন আনন্দচাঁদ৷ তাঁদের পরলৌকিক ক্রিয়ার দায় তাঁরই৷ তাঁর এ অধিকার বৈষ্ণব গৃহস্থ সম্প্রদায়ই দিয়েছে। লোকের বিশ্বাস আনন্দচাঁদ যাদের পরলৌকিক ক্রিয়ার দায়িত্ব নেন, তাঁদের জীবনের কর্ম যায় হোক না কেন মোক্ষ তাদের অবধারিত।
আনন্দচাঁদকে শক্তিসাধক ব্রজমোহন ভট্টচার্য প্রথমে শক্তিমন্ত্রেই দীক্ষা দিয়েছিলেন। এমনকি ভট্টাচার্য তাঁর শিষ্যকে যোগিনী – বিদ্যা দিয়ে এক রাত্রের সাধনায় সিদ্ধি পর্যন্ত পাইয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আনন্দচাঁদের মন শ্যামা নয় শ্যামকে খোঁজে। আর সেই খোঁজার টানেই তিনি ছুটে গেলেন ইলামবাজারের প্রেমদাস মহান্তের কাছে। বৈষ্ণবতন্ত্রে সাধনকামী লোকেরা সিদ্ধপুরুষ প্রেমদাস বৈরাগীর কাছে দীক্ষা নিত। আনন্দচাঁদও তাঁর কাছে বৈষ্ণবতন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ করেন। এরপর তিনি অচিরেই এই অঞ্চলের বৈষ্ণবদের মাথার মণিতে পরিণত হয়।
আনন্দচাঁদ গোস্বামী নাকি ছিলেন একাধারে ব্রহ্মজ্ঞানী, বাক্যসিদ্ধি ও অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। তাঁর এই অলৌকিক ক্ষমতার এক গল্প আজও সুপুরে কান পাতলেই শোনা যায়। খুসুটিকুরির সিদ্ধপুরুষ হজরত হোসেন একবার আনন্দ ঠাকুরের শক্তি পরীক্ষার জন্য বাঘের পিঠে চড়ে দেখা করতে আসছিলেন৷ সঙ্গে উপঢৌকন এনেছিলেন সোনার থালায় খাঞ্চিপোশে ঢেকে হিন্দুর নিষিদ্ধ গোমাংস। আনন্দ ঠাকুর তখন একটা ভাঙা পাঁচিলের উপর বসে কাজকর্ম দেখছিলেন। হজরত বাঘের পিঠে সুপুরের প্রান্তে উপস্থিত হতেই আনন্দচাঁদ পাঁচিলকে বললেন চল। পাঁচিল চলতে লাগল, এসে হাজির হল গ্রামে ঢোকবার পথে৷ হজরত তো এই দৃশ্য দেখে অবাক। তাঁর আর সাহস হচ্ছিল না, ঐ উপঢৌকন আনন্দচাঁদকে দেবার৷ আনন্দচাঁদ কিঞ্চিৎ হেসে তাঁর কাছে উপঢৌকনটি দেখানোর জন্য অনুরোধ করলেন৷ হজরত থালার কাপড় সরাতেই হতচকিত হয়ে গেলেন, থালায় মাংস কই, এ তো সদ্য ফোঁটা পদ্ম পুষ্প। হজরত হোসেন লজ্জিত হলেন ও আনন্দচাঁদের অলৌকিক ক্ষমতা সম্পর্কে অবহিত হলেন।
১৭৪১ থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত সাল পর্যন্ত বাংলায় বিশেষ করে বীরভূম, বর্ধমান, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ভয়ানক বর্গী আক্রমণ ঘটে। বর্গীরা ছিল জাতিতে মারাঠা, সংঘবদ্ধ ও লুঠতরাজপ্রিয় অশ্বারোহীর দল। বাংলায় এই বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন ভাস্কর পন্ডিত৷ বীরভূমে বর্গী প্রতিরোধের কেবল তিনটি কথাই জানা যায়- ১) ইটান্ডার জোড়াল খাঁর নেতৃত্বে ২) কচুজোড়ের রাজা রুদ্রচরণ রায়ের নেতৃত্বে এবং ৩) সুপুরের আনন্দচাঁদের নেতৃত্বে।
১৭৪৫ সালে বীরভূমে বর্গী আক্রমণকালীন অবস্থায় আনন্দচাঁদ গোস্বামী একদা এই আক্রমন প্রতিহত করতে সমর্থ হয়। বর্গীরা বীরভূমের হেতমপুরে লুঠ করে, সেখান থেকে গ্রামের পর গ্রাম লুঠ করে ইলামবাজার হয়ে পৌঁছায় সুপুরে। বর্গীর দল ছুটন্ত ঘোড়ায় চেপে আরও এক বিভীষিকা কান্ড ঘটাতে আনন্দচাঁদের আশ্রমের দ্বার প্রান্তে এসে উপস্থিত। কিন্তু এই লুঠতরাজ নর হত্যকারীর দল, এবার ভাবতেও পারেনি তাদের সঙ্গে কি ঘটতে চলেছে। বর্গীরা আক্রমণে যেই না উদ্যত হয়েছে, অমনি আনন্দচাঁদ তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা প্রকাশ করেন৷ বর্গীরা একই সময়ে আনন্দচাঁদকে সাদা ঘোড়ার উপর আরূঢ় হয়ে চার ফটকের সামনেই উপস্থিত দেখতে পান। এ ঘটনায় বর্গীরা ভীত হয়ে সুপুর ছেড়ে পালিয়ে যায়। কারো কারো মতে বর্গীদের আক্রমনের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে আনন্দচাঁদের নেতৃত্বে স্থানীয়রা সুপুরের পুকুরগুলিতে খাল কেটে গড় তৈরি করে, সকলে অস্ত্রসজ্জিত হয়ে লুকিয়ে থাকে। বর্গীরা আক্রমণ করতে এলে তারা আকস্মিক পাল্টা তীব্র আক্রমণ শুরু করে৷ তাছাড়া এত সম্পত্তির অধিকারী আনন্দচাঁদের যে লেঠেল বাহিনী থাকা অস্বাভাবিক নয়, তা বলাই বাহুল্য। হয়তো এরাও বর্গী প্রতিরোধে সদর্থক ভূমিকা নিয়েছিল। স্বভাবতই বর্গীরা পিছু হঠতে বাধ্য হয়।
যা হোক আনন্দচাঁদের নেতৃত্বে সুপুরের বাসিন্দারা বর্গীদের যে কড়া টক্কর দিয়েছিল, তা বলাই বাহুল্য। সম্ভবত এই কারনেই তিনি বীর উপাধি পান। তাঁর নামানুসারেই সেই স্থানে গ্রামবাসীরা অধুনা ‘বীর গোস্বামী’ ক্লাব তৈরি করেন। সুপুর থেকে পালিয়ে বর্গীরা হানা দেয় পার্শ্ববর্তী গৌরাঙ্গপুর, লোহাগড়, গোয়ালপাড়া গ্রামগুলিতে৷ কিন্তু এখানকার আদিবাসীরা তার আগেই গভীর বনের মধ্যে আশ্রয় নেওয়ায়, তাদের বিশেষ ক্ষতি হয়নি। বর্গীরা এই ঘটনার পর দিনই বিহার অভিমুখে এগিয়ে যায়।