প্রদীপ্ত দত্ত : একসময় কলকাতা, সুতানটি, গোবিন্দপুরের মতোই ছোট অঞ্চল ছিল গড়িয়া জনপদ। গঙ্গার প্রধান শাখা যা বর্তমানে আদি গঙ্গা নামে পরিচিত এই অঞ্চলের ওপর দিয়েই বয়ে যেত। সেই নদীর স্মৃতি কঙ্কাল এখনো রয়ে গেছে গড়িয়া অঞ্চলে।
বিংশ শতকের পঞ্চাশের দশকেও শহর কলকাতার সঙ্গে গড়িয়ার প্রভেদ ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে বৃহত্তর কলকাতার সঙ্গে গড়িয়া জুড়ে গেছে। ঠনঠনিয়া কালিবাড়ি, চিৎপুর, বাগবাজার, চৌরঙ্গি, ফোর্ট উইলিয়াম, ধর্মতলা খুব সহজে গড়িয়ার মেট্রো স্টেশন কবি সুভাষে ট্রেন ধরে পৌঁছে যাওয়া যায় এখন। কিন্ত একসময় গোলদিঘী পাড় থেকে টলি সাহেবের বাজার (যা বর্তমানে টালিগঞ্জ নামে বর্তমানে পরিচিত) গড়িয়া, যাদবপুরে আসত ঘোড়ায় টানা বাস। বর্তমান এখানে গড়ে উঠেছে আকাশ ছোঁয়া সব আবাসন, শপিংমল, সিনেমা হল, প্রশস্ত বাইপাস সরকারি ও বেসরকারি বাসের আধুনিক টার্মিনাল।
গড়িয়া শহর ও গড়িয়া স্টেশন অঞ্চলের মধ্যে যে দূরত্ব ছিল একসময় তাও মুছে গেছে কালের নিয়মে। কলকাতার সঙ্গে জুড়ে গড়িয়া এখন মাল্টিকালচারের মেট্রো শহর। কিন্তু তারফলে হারিয়ে গেছে গড়িয়া জনপদের আপন পরিচয়। গড়িয়া সংলগ্ন বোড়াল গ্ৰাম এইতো সেদিন পথের পাঁচালীর গ্ৰামের শ্যুটিং হয়েছিল। শান্তিনিকেতনে গুরু নন্দলালের কাছে যে গ্ৰাম দেখতে শিখেছিলেন পথের পাঁচালী নির্মাণের সময় তাকে খুঁজে পেয়েছিলেন কলকাতার কাছে এই গড়িয়া অঞ্চলেই।
দীনেশ সেন, পুর্ণেন্দু পত্রী, শ্রী পান্থর লেখালেখিতে উঠে এসেছে প্রাচীন বাংলা, পুরনো দিনের কলকাতার অনেক স্মৃতিকথা। সেই স্মৃতিকথা বলছে বাঙালির প্রথম নবজাগরণের পথিকৃৎ নদীয়ার গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই গড়িয়া জনপদ।
১৫১০ নাগাদ শ্রীচৈতন্যদেব শান্তিপুর থেকে যখন যাত্রা করেছিলেন নীলাচলের দিকে। আদি গঙ্গার তীর ধরে তখন গড়িয়া ও পদ্মশ্রী সংলগ্ন আদি গঙ্গার ঘাটে স্নান করেছিলেন বলে লোকশ্রুতি। সেই আদি ঘাট কি তবে আজকের গড়িয়া অঞ্চলের বৈষ্ণব ঘাটা। গঙ্গার ঘাটেই কাছে ছিল মহাশ্মশান। নরেন্দ্রপুর যাবার রাস্তার পাড়েই আছে আজকের সেই মহাশ্মশান।
আবুল ফজলের আইন আকবরীতেও আছে এই অঞ্চলের ইতিহাস। বারো ভুৃঁইয়ার দাপট ছিল ২৪ পরগণার এই বিস্তির্ণ অঞ্চলে। আকবরের সচিব ছিলেন টোডরমল। তিনি ভাগীরথী পূর্ব তীর থেকে সুন্দরবন সংলগ্ন বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত এই অঞ্চলকে ২৪ টি পরগণায় ভাগ করেন। সেখানে মেদনমল্ল পরগণার অন্তর্গত ছিল গড়িয়া, মহামায়াপুর কামালগাজীর মত জনপদ।
নদীপথে, সুমদ্রপথে এইসব অঞ্চলে একসময় ছিল পর্তুগিজ বণিকদের দাপট। বাংলার বণিকরা এদের সাথেই ব্যবসা বাণিজ্য করতো। এই বণিকদের পূর্ব পুরুষরা ছিল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বি বণিক গোষ্ঠীর লোক। চৌতন্যের প্রভাবে এরা বৌদ্ধ ধর্ম গ্ৰহণ করেন। এই বণিকরা যেখানে যেখানে গেছে তার স্মৃতি চিহ্ন রেখে গেছেন। গড়িয়ার বৈষ্ণবঘাটা অঞ্চল সেই স্মৃতি চিহ্ন আজও বহন করছে।
মুকন্দরাম চক্রবর্তীর চন্ডীমঙ্গলে বৈষ্ণব ঘাটার নাম আছে। বণিক ধনপতির পুত্র শ্রীমন্ত যাচ্ছেন বাণিজ্য যাত্রায়। ভাগীরথী হয়ে সিংহলে যাবে তাঁর বাণিজ্য তরী। সেখানে পাওয়া যায় -“নাচনগাছা বৈষ্ণবঘাটা বামদিকে থুইয়া।
দক্ষিণেতে বারাসত গ্ৰাম এড়িইয়া
ডাইনে অনেক গ্ৰাম রাখে সাধুবালা
ছত্রভোগে উত্তরিল অবসানবেলা।।” এই গড়িয়া জনপদ যে খুব প্রাচীন তাতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ ভাগীরথীর এই জলপথ ধরে সম্ভবত মধ্যযুগের আগে থেকেই বাণিজ্য তরী নিয়ে তাম্রলিপ্ত বন্দর হয়ে বাংলার বণিকরা জাভা, সুমাত্রা সিংহলে বাণিজ্য করতে যেত। সেন বংশের অধিকারেও এই অঞ্চল একসময় এসেছিল।
লৌকশ্রুতি এই গৌড়িয় অলৌকশ্রুতি এই গৌড়িয় অঞ্চলে বসবাস করত বহু গৌড়ীয় সম্প্রদায়ের মানুষ। সেখান থেকেই আসে এই গোড়ীয়া অঞ্চলের নামকরণ। আবার কেউ কেউ বলেন ম্যানগ্ৰোভ জাতীয় গুড়িয়া গাছের আধিক্য ছিল একসময়। সেখান থেকে গড়িয়া নামটি এসেছে। আবার অন্য দলের বক্তব্য গৌড় রাজ্যের হিন্দু থেকে মুসলমান হওয়া ধর্মাবলম্বীদের বসবাস ছিল একসময়। অতীত স্মৃতির সুতো গেছে ছিঁড়ে। তাই গড়িয়ার
প্রাচীন ইতিহাসের অনেকটাই এখন কালের গর্ভে। গড়িয়া এখন আধুনিক কলকাতার ব্যস্ততম অঞ্চলের চেহারা নিয়ে ছুটে চলেছে।