নিজস্ব প্রতিবেদন : বর্তমানে পুরো বিশ্বে মহামারীর আকার ধারণ করেছে করোনা ভাইরাস। কোনো সংক্রামক রোগ যখন বিশাল একটি জনগোষ্ঠীর মাঝে খুব অল্প সময়ে সংক্রামিত হয়ে পড়ে তখন বলা চলে সেই রোগটিকে মহামারী বলা হয়। পৃথিবীতে যুগে যুগে অসংখ্য মহামারীর ঘটনা ঘটেছে, মৃত্যু হয়েছে কোটি কোটি মানুষের। তবে হুয়ের দাবি, করোনা অন্যান্য ভাইরাস মহামারীকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে।
যখন কোনও মহামারী একটি ছোট জায়গায় আটকে না থেকে তা বহু জায়গায় ছড়াতে শুরু করে তখন তাকে বলে ‘প্যান্ডেমিক’ বা বৃহত্তর মহামারী। উল্লেখ্য, মহামারীর তুলনায় বৃহত্তর মহামারীর বিস্তার বেশিদিন সময় পর্যন্ত থাকে। তা কয়েক বছর পর্যন্তও চলতে পারে। আর করোনাকে ‘প্যান্ডেমিক’ ঘোষণার পর থেকে সেই আশঙ্কা বাড়ছে।
এই প্রথমবারই বিশ্বে বৃহত্তর মহামারী হয়নি, এর আগেও এই গ্রহ অনেক মহামারী দেখেছে। ২০০৫ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্যে এইডস-এ বিশ্ব জুড়ে মৃতের সংখ্যা ৩৬ মিলিয়ন। তার আগে ১৯৬৮ সালে জ্বরের জেরে বিশ্বে ১ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়। তারও আগে ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮ সালের মধ্যে ২ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এশিয়াব ফ্লু-তে। করোনার আগেও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল মহামারীর কবলে পড়েছে। তবে এক বিংশ শতাব্দীর মানুষেরা তেমন ভাবে কোনো মহামারী প্রত্যক্ষ করেননি। মহামারী কত বড় অঞ্চল নিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে এর থেকে সেই রোগের ধর্ম বোঝা যায়। বর্তমানে করোনা ভাইরাস থেকে সৃষ্ট কোভিড ১৯ পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে।
ভারতে ছড়িয়ে পড়া ১২টি মহামারীর তালিকা
এন্সফেলেটিস লেথার্জিকা : এনসেফালাইটিস লেথারজিকা, যা ‘লেথারজিক এনসেফালাইটিস’ নামেও পরিচিত। এক প্রকার মহামারী এনসেফালাইটিস যা ১৯১৫ থেকে ১৯২৬ সালে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই রোগে মানব শরীরে শক্তি হ্রাস, উদাসীনতা, হতাশা এবং অলসতা দেখা যেত। ১৯১৯ সালের মধ্যে এটি বিশ্বের বিভিন্ন অংশে বিশেষত কানাডা, মধ্য আমেরিকা এবং ভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল। একে এনসেফালাইটিস এ এবং ইকোনমিকো এনসেফালাইটিস বা রোগও বলা হত।
ভারতীয় ডাক্তার জে ই ধুঞ্জিভয় এই রোগ নিয়ে তার গবেষণায় ১৯২৯ সালের জুলাই মাসে প্রকাশ করেন। যেখানে তিনি এই ভাইরাস সংক্রমণকে ‘অ্যাকিউট কন্টাগিওস ডিসিস’ বলেছেন। এই ভাইরাসটি মানুষের নার্ভ সিস্টেম এবং মস্তিষ্কের ধূসর পদার্থের ক্ষতি করত। ১৯১৭ সালে ইউরোপের ভিয়েনা থেকে শুরু করে সেই বছরই এটি সমগ্র ইউরোপ মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এই রোগের ফলে মনে করা হয় বিশ্বে প্রায় ১.৫ মলিয়ন মানুষ মারা যান।
স্প্যানিশ ফ্লু : বিশ্বের মানুষ যখন এনসেফালাইটিস লেথারজিকার সাথে মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে তখনই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বিশ্ব মহামারী রূপে দেখা দিয়েছিল স্প্যানিশ ফ্লু। এটি একটি এক রকমের ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং প্রবল ভাবে সংক্রমণ ধর্মী। মূলত সেই সময় বিশ্বযুদ্ধ চলার ফলে এই ভাইরাস সংক্রমণ ভীষণভাবে বৃদ্ধি পায়। গবেষণা বলে পুরো বিশ্বে প্রায় ৫০ মিলিয়ন মানুষ এবং ভারতে প্রায় ১০-২০ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয় এই ভাইরাসের ফলে।
কলেরা : ভিব্রিও কলেরা এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া যেটি ১৮১৭ থেকে সাতটি কলেরা প্যান্ডামিক ঘটিয়েছিল। ১৯৬১ সালে ইন্দোনেশিয়ার মাকাসার শহরে আবির্ভূত হয়ে চিহ্নিত হওয়ার পরে ভিবরিও কলেরা জীবাণুর এল টোর স্ট্রেন সপ্তম কলেরা মহামারী সৃষ্টি করে। পাঁচ বছরের কম সময় এটি এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং ১৯৬৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশে এসে পৌঁছায়, ১৯৬৪ সালে ভারতে। কলকাতায় এর প্রভাব সবথেকে বেশী পড়েছিল।
দক্ষিণ এশিয়া থেকে এটি ধীরে ধীরে আফ্রিকা ও পড়ে ইউরোপ মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। অপরিচ্ছন্নতা, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদির ফলে এই রোগটি পুরো বিশ্বে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭০ সালের মধ্যে জাপান এবং দক্ষিণ প্রশান্তেও ছড়িয়ে পড়ে রোগটি। একটি গবেষণায় দেখা যায় ল্যাটিন আমেরিকার পেরুতেই ১০,০০০ মানুষের এই রোগে মৃত্যু ঘটে। ১৯৯১ সাল পর্যন্ত প্রায় ৬ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয় এই রোগে।
ফ্লু প্যান্ডামিক : এই মহামারী ঘটেছিল ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের H3N2 স্ট্রেইনের জন্য যেটি ১৯৬৮ সালের জুলাই মাসে হংকং শহরে ভীষণভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল।পরবর্তীকালে এটি সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম এবং দুই মাসের মধ্যে ভারত, ফিলিপাইন, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের পরে এটি যুক্তরাষ্ট্রেও ছড়িয়ে পড়ে। সম্ভবত বিশ্বের ১ মিলিয়ন মানুষের এই রোগে মৃত্যু হয়।
স্মল পক্স : সংক্রামক রোগটি দুটি ভাইরাস ভেরিয়েন্ট ভেরিওলা মেজর এবং ভারিওলা মাইনর উভয়ের মাধ্যমেই হয়। এই ভাইরাসটির প্রথম দেখা যায় ভারতে। মিচিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের মতে ১৯৬০ এর দশকে ৬০% স্মল পক্স ভারতেও দেখা যায়। এর পর পশ্চিম আফ্রিকা এবং ১৯৬৬ সালের মধ্যে বিশ্বের প্রায় ২২ টি দেশের মধ্যে এটি ছড়িয়ে পরে। এর ফলে পুরো বিশ্বে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। ১৯৭২-১৯৭৫ এর মধ্যে হু-এর তরফ থেকে এই স্মল পক্সের ভ্যাকসিন প্রদান করা হয়, মূলত ভারতে। ১৯৭৭ সালের মধ্যে ভারতকে স্মল পক্স মুক্ত দেশ বলে ঘোষণা করা হয়।
প্লেগ : ১৯৯৪ এর সেপ্টেম্বরে ভারতে সুরাটে নিউমোনিয়াক প্লেগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায় এবং তার সাথেই ভুল তথ্য এবং গুজব ছড়াতে শুরু করে ফলে অনেক মানুষ শহর ছেড়ে অন্য জায়গায় যেতে থাকে। এর ফলে ভারতের নানান স্থানে এটি ছড়িয়ে পড়ে। এক সপ্তাহের মধ্যে ১০০০ টি কনফার্ম কেস এবং ৫০ জনের মৃত্যু ঘটে। মূলত অপরিচ্ছন্নতার ফলেই এই অসুখ ছড়িয়ে পড়ে এবং পরবর্তী কালে সরকারের তরফ থেকে শহর পরিষ্কারের উদ্যোগ নেওয়া হলে ধীরে ধীরে এই অসুখের প্রভাব কমতে থাকে।
সার্স : ২০০৩ সালের এপ্রিল মাসে ভারতে প্রথম সার্সের খোঁজ পাওয়া যায় এবং এর উৎপত্তি স্থল হিসেবে সিঙ্গাপুরকে চিহ্নিত করা হয়। একুশ শতকের সর্বপ্রথম ভয়ংকর সংক্রামক রোগ ছিল সার্স। পৃথিবীর ৩০টি দেশে ছড়িয়ে পরা এই ভাইরাসের কারণ ছিল এক ধরনের করোনাভাইরাস।
হেপাটাইটিস : দূষিত রক্ত শরীরে গেলে সাধারণত এই রোগ হয়। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গুজরাটের মোদাসায় হেপাটাইটিস বি-তে ১২৫ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন। বিশেষজ্ঞদের মতে ব্যবহৃত দূষিত সিরিঞ্জ ব্যবহারের ফলেই এঁদের এই সংক্রমণ ঘটেছিল।
জন্ডিস : ২০১৪ সালের ওড়িশায় জন্ডিসের প্রকোপ দেখা গিয়েছিল। তিন মাসের মধ্যে মারা গেছিলেন ৬ জন, আক্রান্ত হয়েছিলেন ৬৭০ জন। নর্দমার দূষিত জল পানীয় জলের পাইপে মিশে যাওয়ায় এই সংক্রমণ ঘটেছিল। আক্রান্ত হয়েছিলেন মোট ৩৯৬৬ জন মারা গেছিলেন ৩৬ জন।
সোয়াইন ফ্লু : ২০১৪ সালের শেষে এই H1N1 ভাইরাসের সব থেকে বেশি প্রাদুর্ভাব দেখা গিয়েছিল গুজরাট, রাজস্থান, দিল্লি, মহারাষ্ট্র ও তেলেঙ্গানায়। এক বছরের মধ্যে সারা দেশে ৩৩ হাজার সংক্রমণের খবর আসে এবং ২০০০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।
এনসেফালাইটিস : এই রোগের প্রধান কারণ মশার কামড়, যা থেকে দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক প্রতিবন্ধকতা হতে পারে যার জেরে ঘটে মৃত্যু। গোরখপুরে এই প্রাদুর্ভাবের কারণ ছিল পরিচ্ছন্নতা ও শৌচ ব্যবস্থার অভাব। এই রোগের কারণে ১৩০০-র বেশি শিশুর মৃত্যু ঘটে।
নিপা ভাইরাস : ফলখেকো বাদুড় থেকে এই নিপা ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে। ভারতে এই রোগ মূলত ছড়িয়েছিল কেরালায়। স্থানীয় প্রশাসন ও নেতৃত্বের সহায়তায় এই রোগ রাজ্যের বাইরে ছড়াতে পারেনি। এই রোগের কারণে এক মাসে ১৭ জনের মৃত্যু ঘটে এবং এক মাস পর এই রোগ সম্পূর্ণ নির্মূল হয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়।