নিজস্ব প্রতিবেদন : ঠিক গত সপ্তাহেই চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং চীনা সেনাবাহিনীকে সার্বভৌমত্ব রক্ষার যুদ্ধের জন্য তৈরি থাকতে বলেন। অন্যদিকে আবার বেশ কিছুদিন ধরেই চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির মুখপাত্র ‘দি গ্লোবাল টাইমস’-এ ভারতকে লক্ষ্য করে নানান আক্রমণাত্বক লেখা প্রকাশিত হয়! যদিও এর আগেও ভারতের প্রতিবেশী দেশ চীনের সাথে সীমান্ত অঞ্চলে যুদ্ধ হয়েছে ভারতের কিন্তু হঠাৎ এই বিশ্ব মহামারীর আবহে যুদ্ধের প্রস্তুতি কেন? প্রশ্ন উঠছে সব মহলেই। তবে এর পিছনে রয়েছে বেশ কতকগুলি কারণ। অন্ততপক্ষে বিশেষজ্ঞরা এমনটাই মনে করছেন।
ভারত ও চীন এই সংঘাতের ৫টি কারণ
১. চীনের ক্ষমতা বিস্তারের লালসা : দেশ বিদেশের অনেক বিশেষজ্ঞদের মতে সারা বিশ্ব যখন মহামারি করোনা নিয়ে ব্যস্ত তখন এই পরিস্থিতিকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে চীন। বিশ্বে নিজের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে চীন। সীমান্তে চাপ বৃদ্ধির পাশাপাশি হংকংয়ে সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছে চীন। পর্যবেক্ষকদের মতে ২০০৮ সালে যখন বিশ্ব অর্থনৈতিতে চূড়ান্ত মন্দার পরিস্থিতি তৈরি হয় তখন যে দেশগুলি সংকটে পড়েছিল তাদের ঋণ দিয়ে সাহায্য করেও সেইসব দেশের উপর নিজের প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করেছে চিন।
২. ভারতের ওপর ক্ষোভ : বিশেষজ্ঞরা আরও জানিয়েছেন লাদাখ সীমান্তে গালওয়ান উপত্যকায় ভারত যেভাবে কাঠামো বিস্তার করছে তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছে চীন সরকার। এই বিষয়টি কোনো মতেই মেনে নিতে পারেনি চীন। সীমান্ত নিয়ে চীন ও ভারতের বিরোধ অনেক দিন ধরে চলে এলেও গত বছর দশেক ধরে সীমান্তে সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রাক প্রস্তুতি হিসেবে ভারতের তৈরি করা কাঠামো উদ্বিগ্ন করে তুলেছে চীনকে। ভারতে মোদী সরকরের ক্ষমতায় আসা ও তার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের রাজনৈতিক ও সামরিক নৈকট্যও চীনের ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৩. চীনের মহাসড়ক নিয়ন্ত্রণ : হংকং ভিত্তিক এশিয়া টাইমস-এর একটি লেখার ভিত্তিতে সুইডিশ বিশ্লেষক বার্টিল লিনটার বলছেন, চীনের কাছে লাদাখে ভারত সরকারের সড়ক নির্মাণ একটি হুঁশিয়ারি হিসেবে প্রতিফলিত হয়েছে। তাদের কথায় মূলত পশ্চিম জিনজিয়াং প্রদেশের কাসগর শহর থেকে তিব্বতের রাজধানী লাশা পর্যন্ত চীন একটি মহাসড়ক তৈরি করেছিল মূলত সামরিক কৌশলের জন্য। বর্তমানে তার নিয়ন্ত্রণ নিয়েও চীন উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে।
৪. সীমান্ত সংঘাত : লাদাখে চীন-ভারত সীমান্তে পানগং লেকের বাসিন্দাদের আনুগত্য নিয়েও বেশ আশঙ্কা রয়েছে চীনের। এই এলাকাতেই ভারত ও চীন দুই দেশ সৈন্য সমাবেশ করে। অন্যদিকে চীনের তৈরি করা বিশেষ মহাসড়ক আকসাই চীন নামে একটি অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে গেছে যেটি ভারতীয় মানচিত্রের অংশ এবং ভারত সেটাকে নিজেদের অঞ্চল বলে মনে করে। মি. লিনটার-এর মতে সেই অঞ্চলে ভারতের কাঠামো নির্মাণ মানতে নারাজ চীন।
অন্যদিকে বেশ কিছুদিন ধরেই চীনের গ্লোবাল টাইমসের সম্পাদকীয় ও উপ-সম্পাদকীয়তে ভারতের বিরুদ্ধে কড়া হুশিয়ারির ভাষা প্রয়োগ করা হচ্ছে। যেখানে বারবার বলা হচ্ছে ‘ভারতের সেনাবাহিনীকে চরম মূল্য দিতে হবে’। ১৯শে মে তাদের প্রকাশিত সংখ্যায় এই সংবাদমাধ্যম লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় ভারতের কাঠামোকে ‘অবৈধ প্রতিরক্ষা স্থাপনা’ বলে ভারতকে অভিযুক্ত করেছে।
তবে এবার প্রথম নয়, ১৯৬২ সালে সীমান্ত নিয়ে দুদেশের মধ্যে যুদ্ধ হয়। ২০১৭ সালেও সীমান্ত নিয়ে সংঘাত তৈরি হয়। ভুটানের সীমান্তে ডোকলাম নামক একটি এলাকায় চীনের রাস্তা তৈরিতে ভারতের আপত্তি থাকায় চীন ও ভারতের সৈন্যরা টানা ৭২দিন ধরে মুখোমুখি দাঁড়ায় এবং যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল।
তবে এখানেই শেষ নয়, ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে গ্লোবাল টাইমস ২৫শে মে এক সম্পাদকীয়তে লেখে চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে উত্তেজনা থাকলেও ১৯৬২ সালের যুদ্ধের তুলনায় আন্তর্জাতিক স্তরে চীনের অবস্থা এখন অনেক ভালো। চীনের অর্থনীতি ভারতের অর্থনীতির পাঁচ গুণ এমনটাও বলা হয়।এগুলিকেই বিরল হুঁশিয়ারি হিসেবে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
৫. ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্ব : সৈয়দ মাহমুদ আলী, যিনি ভারত-চীন শত্রুতা নিয়ে গবেষণা-ধর্মী একটি বইয়ের রচয়িতা। তিনি বিবিসি সংবাদমাধ্যমকে বলেন বিশ্বে বেড়ে চলা চীনের প্রভাব কমানোর জন্য বিগত দশক ধরে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র যে ‘অক্ষশক্তি’ তৈরি করেছে, চীনের মতে ভারত তার মূল অংশ। আমেরিকাও মনে করে চীনকে বশে আনার প্রধান হাতিয়ার হতে পারে ভারতই। এইজন্যই গত এক দশকের মধ্যে আমেরিকা ভারতের কাছে ২০০ কোটি ডলারের মত অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র বিক্রি করেছে বলেই জানান তিনি।
চীনের গ্লোবাল টাইমস-এর সম্প্রতি কিছু লেখাতেও ইঙ্গিত প্রকাশ করা হয়েছে চীন ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি করা অক্ষশক্তির মূল অংশ মনে করছে। ২৫শে মে এক চীনা বিশ্লেষক লং শিং চুং এক উপ-সম্পাদকীয়তে ভারতকে উদ্দেশ্যে করে লেখেন ভারত সরকার তাদের দেশকে যেন যুক্তরাষ্ট্রের কামানের গোলা হিসেবে ব্যবহার না হতে দেন। এছাড়াও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিষয় সতর্ক থাকতে হবে দুই দেশকেই কারণ যুক্তরাষ্ট্রের স্বভাব শান্তি এবং স্থিতিশীলতা নষ্ট করা।
এছাড়াও আরও একটি কারণ রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। যে কারণটি সম্পূর্ণভাবে চীনের অর্থনীতির উপর প্রভাব ফেলতে পারে। তা হল বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতের আত্মনির্ভর হওয়ার পরিকল্পনা বা প্রস্তুতি। বর্তমান করোনা আবহে বিশ্বের প্রতিটি দেশ যখন আর্থিকভাবে সংকটের মধ্যে দিয়ে পার হচ্ছে তখন ভারত নিজেদের আর্থিক ব্যবস্থাকে সুদীর্ঘ করে তোলার জন্য, দেশকে আত্মনির্ভর করে তোলার জন্য একগুচ্ছ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে কেন্দ্র সরকারের তরফ থেকে। আর এমনটা হলে চীন আর্থিক দিক দিয়ে অনেকটাই ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে এমন আশঙ্কা করছে বেজিং সরকার।