ইচ্ছেই শেষ কথা, দৃষ্টিশক্তি হারিয়েও প্রথম প্রচেষ্টাতেই সিভিল সার্ভিসে সফল তরুণী

নিজস্ব প্রতিবেদন : বলা হয় ভাগ্য মানুষের হাতের রেখায় থাকে না, ভাগ্য মানুষের হাতে থাকে। অর্থাৎ নিজেদের হাত দিয়ে পরিশ্রম করে ভাগ্যকে গড়ে নিতে হয়। তপস্বিনীর ঘটনা শুনলে এমনটাই মনে হবে।

সে জন্মের সময় কোন প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্মায় নি। আর পাঁচটা স্বাভাবিক শিশুর মতই সে জন্মে ছিলো। কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকেই প্রতিবন্ধকতা তার সঙ্গী হয়ে যায়।

তপস্বিনীর বয়স যখন সাত বছর তখন থেকেই তার অসহ্য মাথাব্যথা শুরু হয়। অসহ্য মাথা ব্যথার কী কারণ জানতে তাকে ডাক্তার দেখায় তার বাবা অরুণ কুমার দাস ও মা কৃষ্ণপ্রিয়া মহান্তি। ওড়িশা সরকারের উচ্চপদস্থ আধিকারিক ছিলেন তপস্বিনীর বাবা। আর মা ছিলেন‌ স্কুল শিক্ষিকা। তাদের দুজনের মধ্যে কেউই ঘুনাক্ষরেও আন্দাজ করতে পারেননি মেয়ের অসহ্য মাথা ব্যথার কারণ আসলে কী।

এরপর চিকিৎসকের কথা শুনে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে তপস্বিনীর অভিভাবকের। চিকিৎসক জানান, তাদের মেয়ের একটি চোখের দৃষ্টিশক্তি একেবারেই শেষ হয়ে গেছে আর একটি চোখের দৃষ্টিশক্তিও দিন কয়েকের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেতে গেলে অস্ত্রোপচার করা দরকার। আশায় বুক বেঁধে তপস্বিনীর অস্ত্রপচার করান তার বাবা-মা। কিন্তু অস্ত্রোপচারের ফল হয় হিতে বিপরীত।

তপস্বিনীর পরিবারের বক্তব্য অনুযায়ী চিকিৎসায় গাফিলতির ফলেই তাদের মেয়ের এত বড় ক্ষতি হয়েছিল। দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার বদলে একেবারেই অন্ধ হয়ে যায় বছর সাতেকের মেয়েটি।

প্রদীপের আলো দপ করে নিভে যাওয়ার মত চোখের সামনে আলোকিত পৃথিবীটাও হুঠ করে অন্ধকার হয়ে গেলো তপস্বিনীর। তবু স্বপ্ন দেখা থামায়নি সে।পড়াশোনায় বরাবরই সে দুর্দান্ত ছিল। ক্লাসে বরাবর প্রথম হওয়া তপস্বিনীকে নিয়ে তার বাবা মায়ের ও অনেক স্বপ্ন ছিল। মেয়ের শিক্ষার পথে যাতে কোনরকম বাধা না আসে সেই কারণে মেয়ের আগের স্কুল থেকে ছাড়িয়ে মেয়েকে দৃষ্টিশক্তিহীন ছাত্র-ছাত্রীদের বিশেষ খুলে ভর্তি করেন তপস্বিনীর বাবা।

এরপর আবার পড়াশুনা শুরু করে তপস্বিনী। অষ্টম শ্রেণী উত্তীর্ণ হয়ে নবম শ্রেণীতে ওঠার পরই জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে ফেলে সে। ওড়িশা রাজ্যের ভুবনেশ্বরের মেয়ে তপস্বিনী সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় যে সে বড় হয়ে কী হতে চায়। নিজের বাবা-মাকেও সে এই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়। তার পাখির চোখ সিভিল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা। তার এই সিদ্ধান্ত সমর্থন করে তার পাশে এসে দাঁড়ান বাবা ও মা।

নিজের ভাগ্যকে বদল করার এই লড়াইয়ের যাত্রাপথে তপস্বিনীর আদর্শ ছিলেন একজনই, তিনি প্রথম দৃষ্টিহীন আইএএস অফিসার প্রাঞ্জল পাতিল। তাকে সামনে রেখেই তপস্বিনী নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন আসন্ন পরীক্ষার জন্য।

এরপর জীবনের সাফল্যের পথে এগিয়ে যান তপস্বিনী। ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়াশোনা শিখে দশম, দ্বাদশ শ্রেণী ও স্নাতক স্তরের পরীক্ষায় চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করেন তিনি। বর্তমানে তপস্বিনী ভুবনেশ্বরের উৎকল বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পড়ছেন। স্নাতকোত্তর পড়াকালীন সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দেন তিনি আর এই পরীক্ষায় তিনি সাফল্যের নজির তৈরি করেন। ওড়িশা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া ২১৮ জনের মধ্যে তপস্বিনী একজন। আর সফলতা আসে তাঁর প্রথম প্রচেষ্টাতেই।

৫ লক্ষেরও বেশি ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে পরীক্ষা দিয়ে মেধা তালিকাতে তপস্বিনী ১৬১ নম্বর স্থান দখল করেন। তিনি দৃষ্টিহীন হওয়ার কারণে প্রতিবন্ধীদের কোটায় বসে পরীক্ষা দেননি। তিনি একজন জেনারেল ক্যাটাগরীর ছাত্রী হিসেবেই পরীক্ষাটি দিয়েছিলেন। আর এই পরীক্ষায় তিনি সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছেন। তার এই উত্তরণ আরও একবার প্রমান করলো জীবনে যত প্রতিবন্ধকতায় আসুক না কেন পাখির চোখটির দিকে লক্ষ্য রেখে যদি এগিয়ে যাওয়া যায় তাহলে লক্ষ্যভেদ হবেই।