নিজস্ব প্রতিবেদন : সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন বাংলার রেনেসাঁর প্রতিনিধি। তাঁর প্রয়াণে বাংলা হারালো বাংলার শিল্প সংস্কৃতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ নক্ষত্রকে। বলাই বাহুল্য এমন অভিনেতার বিকল্প খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। বাংলা সিনেমা জগতে তিনি দীর্ঘ ৬০ বছরের বেশি সময় পের করেছেন। তাঁর হাত ধরেই বাংলা চলচ্চিত্রজগতের বেলা শুরু হয়, পৌঁছে যায় বিশ্বের দরবারে।
অভিনয়ের ক্ষেত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় জলের মতো সিদ্ধহস্ত। তাঁকে যখন যে পাত্রে রাখা হতো তখন তিনি যেন ঠিক সেই পাত্রের আকার ধারণ করতেন। অর্থাৎ হিরো থেকে ভিলেন অথবা ট্রাজিক হিরো সবক্ষেত্রেই নিজেকে সমানভাবে খাপ খাইয়ে উজার করে দিতেন। অপু থেকে ফেলুদা সব চরিত্রেই তিনি ছিলেন অনন্য। আর এমন একজন প্রবাদপ্রতিম অভিনেতার প্রয়াণে শোকোস্তব্ধ গোটা দেশ।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের এক ডজন গপ্পো
১) অপুর সংসার : সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ২৪ বছর বয়সে বিভূতিভূষণের অপুর সংসার। এই ছবিতেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বিভূতিভূষণের অপুর চরিত্রে প্রাণ ঢেলে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। অপুর জীবনের টানাপোড়েনের কাহিনী জীবন্ত হয়ে উঠেছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মধ্য দিয়ে।
২) ক্ষুধিত পাষাণ : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট গল্প ক্ষুধিত পাষাণ অবলম্বনে ১৯৬০ সালে তৈরি হয় এই সিনেমা। এটি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত তৃতীয় সিনেমা ছিল। পাশাপাশি এই সিনেমায় ছিল সত্যজিৎ রায়ের ছত্রছায়ার বাইরে তপন সিনহার পরিচালনায় অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম ছবি। আর এই ছবিতেও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে সেরাটা উজার করে দিতে দেখা গিয়েছিল।
৩) ঝিন্দের বন্দি (১৯৬১) : ঝিন্দের বন্দি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় জীবনের একটি মাইলফলক। তাঁর অভিনয় জীবনের অধিকাংশ ছবিতেই তিনি নায়ক কিন্তু এই সিনেমায় অবলীলায় খলনায়কের অভিনয় করে নিজের অভিনয়ের জাত চিনিয়ে দেন। সমানে সমান লড়াই দেন তপন সিনহার পরিচালিত শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাস ঝিন্দের বন্দি অবলম্বনে তৈরি এই সিনেমায়। উত্তম কুমারকে সমানে সমানে টক্কর দেন এই সিনেমায়।
৪) অভিযান (১৯৬১) : তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযান উপন্যাস অবলম্বনে এই সিনেমাটি বানান সত্যজিৎ রায়। বীরভূম, মুর্শিদাবাদ সংলগ্ন অঞ্চলে বসবাস করে রাজপুত জাতির কিছু মানুষ। সেই সমাজের প্রেক্ষাপট থেকে উঠে আসা মানুষ ও নতুন যুগের গাড়ির আগমন নিয়ে এক ভিন্ন ধারার গল্প নিয়ে সিনেমা বানান সত্যজিৎ রায়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অনবদ্য ভাবে বাংলায় বসবাস কারী এক রাজপুতের দুঃখ, যন্ত্রণা, ইগো, অহঙ্কার, নৈতিকতা অসাধারণ দক্ষতায় ফুটিয়ে তোলেন।
৫) চারুলতা (১৯৬৪) : সত্যজিৎ রায় পথের পাঁচালীর আগে যে সিনেমাটি তৈরি করতে চেয়েছিলেন তা চারুলতা। এই ছবিতে উঠে এসেছে উনিশ ও বিংশ শতকের প্রথম দশকের সময়কালে অভিজাত বাঙালি পরিবারের চালচিত্র। সেই পরিবারে নারীর মনোজগৎ সিনেমার ভাষায় অসাধারণ ভঙ্গিতে তুলে ধরেন সত্যজিৎ রায়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন এই সিনেমা করতে গিয়ে সত্যজিৎ রায় উনিশ শতকের হাতের লেখা আয়ত্ব করার পদ্ধতি শেখান। এর ফলে চীরতরে তাঁর হাতের লেখা বদলে যায়।
৬) তিন ভুবনের পারে (১৯৬৯) : আশুতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি তিন ভুবনের পারেতে সত্তরের দশকের বাঙালির তরুণ সমাজ জীবন সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। মূলত রোমান্টিক ধর্মী ছবি। পাড়ার রকবাজ ছেলেদের জীবন, প্রেম, জীবনের লড়াইয়ে এক তরুণের ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
৭) অরণ্যের দিনরাত্রি (১৯৭০) : প্রায় অচেনা তরুণ লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা নিয়ে এই সিনেমা তৈরি করেন সত্যজিৎ রায়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বন্ধুদের বেপরোয়া বোহেমিয়ান জীবন যাপন এই লেখায় তুলে ধরেন। সত্যজিৎ রায় সেলুলয়েডে সিনেমার ভাষায় তা তুলে ধরেন। এই সিনেমা সিমি গাড়ওয়াল, রবী, ঘোষ সমীত ভঞ্জের মতো অভিনেতারা অভিনয় করেন। সৌমিত্রদের অভিনয় দেখে এই গল্পের সত্যিকারের চরিত্ররা বিস্ময়প্রকাশ করেন। বিশেষ করে সুনীল, শক্তি, সমরেন্দ্ররা।
৮) ফেলুদা সিরিজ : সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বাঙালির কাছে চীরদিন থেকে যাবেন ফেলুদা হিসাবে। তাঁর অন্য সব চরিত্রকে ছাপিয়ে বাঙালির কাছে তিনি প্রিয় ফেলুদা। ১৯৭৪ সালে সোনার কেল্লা ও ১৯৭৯ সালে জয় বাবা ফেলুনাথে তিনি ফেলুদা ওরফে প্রদোষ চন্দ্র মিত্রের ভূমিকায় অভিনয় করেন। বাঙালি মেধার সঙ্গে পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি ফুটে উঠেছে এই চরিত্রে। ব্যক্তি জীবনেও সত্যজিৎ ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও এমন ছিলেন।
৯) গণশত্রু (১৯৮৯) : বাঙালি সমাজ জীবনের কুসংস্কার ও জনসমাজের সেই অন্ধতার সঙ্গে রাজনীতি ও সংবাদপত্রের যোগ সত্যজিৎ ফুটিয়ে তোলেন এই সিনেমায়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এখানে ডাক্তার হিসাবে যেমন সমাজের কুসংস্কার বিরুদ্ধে লড়েছেন তেমন তাঁর অসৎ রাজনৈতিক ভাইয়ের সঙ্গে লড়েছেন । লড়েছেন অসৎ সংবাদপত্র জগৎতের।একজন সৎ ডাক্তার ও সমাজকর্মী হিসাবে তাঁর অভিনয় এই সিনেমায় উজ্জ্বল হয়ে আছে।
১০) কোনি (১৯৮৬ ) : ফাইট কোনি ফাইট, ক্ষিদদার চরিত্রে বলা সৌমিত্রর এই ডায়লগ বাঙালি জীবনে প্রবাদে পরিনত হয়েছে। সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে এক সাঁতার কোচের ভূমিকায় সৌমিত্রর অভিনয় আজও সমান জনপ্রিয়।
১১) পদক্ষেপ (২০০৬) : সুমন ঘোষের পরিচালিত পদক্ষেপ ছবিব জন্য তিনি জাতীয় চলচিত্র মঞ্চে সেরা অভিনেতার পুরস্কার পান। বর্তমান পরিবর্তনশীল জীবনে এক বৃদ্ধের মানিয়ে নেওয়ার এই ছবি। যা চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তোলেন সৌমিত্র।
১২) বেলাশেষে (২০১৫) : বেলাশেষে সিনেমায় সৌমিত্র আশি বছর বয়সে এসেও অসাধারণ অভিনয় করেন। যা জয় করে নেয় বাঙালি সিনেমাপ্রেমীদের হৃদয়। ঘরে বাইরে সিনেমার পর সোমিত্র স্বাতীলেখা দাসগুপ্তর সঙ্গে বহুবছর পর একসাথে অভিনয় করেন। শিবপ্রসাদ নন্দিতার মতো নতুন প্রজন্মের পরিচালকরা সৌমিত্রর উপর নির্ভর করায় প্রমানিত হয় সৌমিত্র কোন মাপের অভিনেতা ছিলেন আশি বছর বয়সে এসেও।
দীর্ঘ অভিনয়ের জীবনের প্রান্তে এসে এই মহান অভিনেতা নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছিলেন আমি সত্যজিত রায়ের তৈরি অভিনেতা। এর চেয়ে বড় পুরস্কার আর কিছু হয় না।