‘চিত্ত যেথা ভয় শূণ্য উচ্চ যেথা শির’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই পঙক্তিটি বরাবরই ভীষণ বিখ্যাত। কিন্তু এই লাইন দুটোর সার্থকতা বোধহয় প্রমাণ করে দেখালেন অভিনেত্রী ঐন্দ্রিলা।
লড়াই আর ঐন্দ্রিলা নাম দুটি সমার্থক হয়ে উঠেছে।
ঐন্দ্রিলা শর্মা বাংলা টেলিভিশনের এক অতি পরিচিত ও জনপ্রিয় নাম। তাঁর জন্ম ১৯৯৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। মুর্শিদাবাদের মেয়ে তিনি। বাবার নাম উত্তম শর্মা, তিনি মুর্শিদাবাদের হাসপাতালের চিকিৎসক। মা হলেন শিখা শর্মা, একটি নার্সিং হস্টেলের ইন-চার্জ। অভিনেত্রী নিজেও স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলকাতার একটি বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়তে আসেন। কিন্তু অসুস্থতার কারণে সে পড়াশোনা শেষ করে উঠতে পারেননি।
আসলে এই টুকু বয়সেই তাঁর উপর দিয়ে যে ঝড় গেছে তাতে অন্য কেউ হলে ভেঙে পড়তো। ঝড়ের প্রথম অভ্যাস পায় নিজের জন্মদিনের দিন। নিজের ১৭ বছরের জন্মদিনের দিন, ২০১৫ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারিতে প্রথম এই মারণরোগের কথা জানতে পারেন ঐন্দ্রিলা। তখন মাত্র একাদশ শ্রেণিতে পড়তেন তিনি। হঠাৎই জানতে পারলেন তাঁর অস্থি মজ্জায় বাসা বেঁধেছে কর্কট রোগ।
সেই থেকে শুরু হলো তাঁর মৃত্যুর সাথে এক অদম্য অথচ অসম লড়াই। এই লড়াইয়ে পদে পেয়েছেন কিছু বন্ধুদের, আবার দুরেও সরে গিয়েছে অনেক আত্মীয় পরিজন। দিল্লিতে চিকিৎসা শুরু হয় অভিনেত্রীর। যদিও তিনি তখনো অভিনেত্রী হয়ে ওঠেনি। চিকিৎসার অঙ্গ হিসাবে চলতে থাকে কেমোর পর কেমো। একের পর এক ইঞ্জেকশন আর কেমোর ধাক্কায় বিকৃত হয়ে যায় শরীর।
তখনও তাঁরা মুর্শিদাবাদের বহরমপুরেই থাকতেন। শরীর ভেঙে যাওয়ার পর আশেপাশের মানুষ এমন ভাবে ঘুরে ঘুরে তাকাতো যেন তারা কোনো ভিনগ্রহের জীবের দিকে দেখছে। রোগ ধরা পড়ার পর দিল্লিতে ডাক্তাররা তো শেষ জবাব দিয়েই দিয়েছিলেন। তারা বলে দেন খুব বেশি হলে আর ৬ মাস হাতে আছে। কিন্তু হল ছাড়লেন না ঐন্দ্রিলা। বাঁচার অদম্য ইচ্ছা ফিরিয়ে নিয়ে এল সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে। ডাক্তাররা হল ছেড়ে দেওয়ার পরও টানা দের বছর ধরে চিকিৎসা চলে তাঁর। আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি।
এরপর সব আবার আগের মতো হয়ে যায়। ২০১৬ সাল থেকে ২০২১ সাল অবধি এই পাঁচ বছর সব ঠিকঠাকই চলছিল। মরণ রোগ থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে অভিনয় জগতে আসেন ঐন্দ্রিলা। ২০১৭ সালে ‘ঝুমুর’ ধারাবাহিক দিয়ে টলিউডে পা রাখেন তিনি। সব কিছুই যখন একেবারে ঠিক ঠাক চলছে তখনই আবার তাল কাটে গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে। ১৪ই ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন ডে দিন প্রথম ডান কাঁধে ব্যাথা অনুভব করেন। তবে শোয়ার দোষে এমন তা হতে পারে এড়িয়ে যান অভিনেত্রী। কিন্তু ব্যাথা যখন ক্রমশ বাড়তে থাকে তখন ছোটেন হাসপাতালে।
হাসপাতালে গিয়ে মাথায় হাত। ডাক্তাররা জানান তাঁর ডান ফুসফুসে একটি ১৯ সেন্টিমিটারের টিউমার তৈরি হয়েছে। শুরু আবার যুদ্ধ, আবারও কেমো, আবারও সেই এক নরক যন্ত্রণা! তবে গত বারের তিক্ত অভিজ্ঞতায় এবার আর চিকিৎসাই করাতে চাননি নায়িকা। সাহস জুগিয়েছে প্রেমিক সব্যসাচী। শেষে মা-বাবা, দিদি আর সব্যসাচী আপ্রাণ বুঝিয়ে আবার তাকে লড়াই করার জন্য তৈরি করেন। তবে এবারের সবচেয়ে কঠিন জায়গাটা ছিল অস্ত্রোপচারের সময়টা।
এমন ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময় ওটি থেকে ফেরেন না রোগী। এমন কি এটা নিয়ে সন্দেহ ছিল চিকিৎসকদের মধ্যেও। এবার সিদ্ধান্ত নিতে হত তাকেই। কিন্তু ভালোবাসার মানুষের ভরসায়, বেঁচে থাকার তাড়নায়, সিদ্ধান্ত নেন অস্ত্রোপচার করার। এবারেও কাছের মানুষের ভালবাসার জোরে ফিরে আসেন। এই লড়াইয়ের শেষে আবারো ছন্দ ফেরেন। নতুন করে শুরু করেন ধারাবাহিকের কাজ।