নিজস্ব প্রতিবেদন : জুন মাসের ১৫ তারিখ রাতে গালওয়ান উপত্যকায় ভারত ও চিন সেনাদের সংঘাতের পর আকসাই চিন দখলমুক্ত করার প্রস্তুতি নিচ্ছে ভারতীয় সেনারা। দিন কয়েক ধরে এমন খবর চোখে পড়ছে বিভিন্ন সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমে। কিন্তু ভারত ভূখণ্ডের এই আকসাই চিন কিভাবে চিনের দখলে গেল? কখন থেকে চিনা দখলে এই এলাকা?
মাসকয়েক ধরেই লাদাখে LAC অর্থাৎ প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর চিন সেনা সমারোহ বাড়তে লক্ষ্য করা যায়। চিন সেনা সমারোহ বাড়তে থাকার পাশাপাশি চুপ করে বসে ছিল না ভারতও। ভারতীয় সেনাবাহিনীর তিন বিভাগকে মোতায়েন করে শক্তি প্রদর্শন করা হয় ভারতে তরফ থেকেও। এমনকি দিন কয়েক আগেই পূর্ব লাদাখে নিয়ে আসা হয়েছে সবথেকে শক্তিশালী টি-৯০ ভীষ্ম ট্যাঙ্ক। তবে ৬২ যুদ্ধের পর থেকেই চিন ভারতীয় ভূখণ্ডের ৩৮ হাজার বর্গকিলোমিটার অংশ জুড়ে থাকা আকসাই চিন এলাকাটি দখল করে বসে রয়েছে।
ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যায়, ১৯৬২ সালের যুদ্ধের সময় লাদাখ সীমান্তে ২০০০ সেনা জওয়ান নিয়ে একটি মাত্রই ব্রিগেড মোতায়েন ছিল। তবে বর্তমানে লাদাখের সীমান্ত সুরক্ষার ৪৫,০০০ সেনা জওয়ান মোতায়েন রয়েছে। এই ৪৫,০০০ সেনা জওয়ান রয়েছে ভারতীয় তিন বিভাগের অংশ থেকে। আর পার্বত্য এলাকায় এই ভারতীয় সেনাদের মোকাবিলা করার জন্য চিনের অন্ততপক্ষে ৫ লক্ষ সেনার প্রয়োজন।
২০১৯ সালের ৫ ই আগস্ট জম্মু কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা বিলোপ করে কেন্দ্র সরকার। আর এরপর জম্মু কাশ্মীর থেকে লাদাখকে আলাদা করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয়। ভারতের এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তীব্র আপত্তি তোলা হয়েছিল চিনের তরফ থেকে। চিনের আপত্তি তোলার মূলে এবং উদ্বেগের কারণ হলো তিব্বত থেকে জিনজিয়াং প্রদেশে যাওয়ার মসৃণ পথ হল আকসাই। আর এই পথ যদি কোনো কারণবশত অবরুদ্ধ হয়ে যায় তাহলে চিনকে জিনজিয়াং প্রদেশে যাওয়ার জন্য বেছে নিতে হবে কারাকোরাম হয়ে বিকল্প পথ। যে পথ অনেকটাই অমসৃণ। আর এই পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে যদি ভারত আকসাই চিনের দিকে এগোয় তাহলে জিনজিয়াং প্রদেশের উপর চিনের আধিপত্য বজায় রাখা অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়বে, এমন কি দখল হারিয়ে ফেলারও যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ এই জিনজিয়াং প্রদেশের উইঘুর মুসলিমদের উপর চিনা সরকারের অমানবিক আচরণ কারোর অজানা নয়।
আকসাই চিন নিয়ে ভারত ও চিনের বিবাদ
আকসাই চিন নিয়ে ভারত ও চিনের বিবাদ দীর্ঘদিনের। এক সময় এই এলাকা ভারতের রাজ্য জম্মু কাশ্মীরের লাদাখের অংশ ছিল। কিন্তু চিন দাবি করে আসছে এই আকসাই চিন এলাকা তাদের জিনজিয়াং প্রদেশের অংশ। আকসাই চিন বিশাল এলাকা নিয়ে অবস্থিত। এই এলাকা ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যের থেকেও বড়। ৩৭,২৪৪ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে রয়েছে এই আকসাই চিন। আর এই এলাকা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন ১৯৫০ সালে যদি নেহেরু সরকার চিনের নকশা নিয়ে সজাগ থাকতো তাহলে এই এলাকা চিনের দখলে যেত না। সেসময় নেহেরু সরকার চিনের গতিবিধি বুঝতে পারেনি। চিন রাস্তা নির্মাণের কাজ শুরু করলে কোন পদক্ষেপ নেয়নি তৎকালীন সরকার। এমনকি তৎকালী সরকার তখন চিনের সামরিক শক্তির গুরুত্ব বুঝতে পারেনি। আর বর্তমান গুরুগম্ভীর অবস্থাতেই লাদাখের বিজেপি সাংসদ জামিয়াং সেরিং নামগিয়াল সর্বভারতীয় একটি সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় দাবি তোলেন আকসাই চিন লাদাখের অংশ। আর এই জায়গা ফিরিয়ে আনার সময় এসেছে বলেও জানান তিনি।
আকসাই চিন ছাড়াও তিনি গিলগিট ও বালতিস্তানের এলাকাকেও লাদাখের অংশ বলে দাবি করেছেন। তিনি আরও জানান, আকসাই চীন যেমন চিনের বেআইনি দখলে রয়েছে ঠিক তেমনি গিলগিট ও বালতিস্তান পাকিস্তানের বেআইনি দখলে রয়েছে। ১৯৬২ সালের চিন-ভারত যুদ্ধে ভারত পরাজিত হয়েছিল বলে এমনটা নয় এখনও ভারত আগের মতোই রয়েছে। এখন ২০২০ সাল, সময় এসেছে এইগুলিকে ফিরিয়ে নেওয়ার।
প্রসঙ্গত, ৩৭,২৪৪ বর্গ কিলোমিটার অংশজুড়ে থাকা এই আকসাই চিনে ১৯৪৭ সালের পর থেকে চিনা অনুপ্রবেশ ঘটে। সেখানে ১৯৫৭ সালে রাস্তা তৈরি করেছিল। এরপর ১৯৫৮ সালে চিন তাদের মানচিত্রে আকসাই চিনকে নিজেদের এলাকা বলে দেখায়। ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পর ১৯৬৩ সালে আকসাই চিনের দখল নয় চিন। এসময় পাকিস্তান আকসাই চিন চিনের হাতে তুলে দেয়। সমুদ্রতল থেকে ১৭,০০০ ফুট উচ্চতায় থাকা এই অঞ্চলে ১৯৪৭ সালের আগে ছিল কাশ্মীরের রাজপরিবারের অংশ। রাজা হরি সিং ১৯৪৭ সালে ভারতের সাথে একীকরণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। আর তখন থেকেই আইনত আকসাই চিন ভারতের অংশ। আর বর্তমানে এই অংশের উপর ভারত নজর দেওয়ার রীতিমতো চাপ বাড়ছে বেজিং সরকারের।