ভারত-চিন যুদ্ধ হলে সামরিক শক্তিতে কে কতটা এগিয়ে

Madhab Das

Updated on:

নিজস্ব প্রতিবেদন : লাদাখের গালওয়ান উপত্যকাকে কেন্দ্র করে চীন ভারতের মধ্যে তৈরি হয়েছে যুদ্ধের পরিস্থিতি। প্রশ্ন উঠছে যদি যুদ্ধ শুরু হয় তাহলে শক্তির বিচারে কোন দেশ এগিয়ে থাকবে। এবছর মার্চ মাসের হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের বেলফার সেন্টারের সমর বিশেষজ্ঞরা তাদের আলোচনায় তুলনায় তুলে নিয়ে আসেন দুই শক্তিধর দেশ সামরিক ক্ষমতায় কোন কোন ক্ষেত্রে এগিয়ে।

ডোকলাম সঙ্কটকে কেন্দ্র করে বেলফারের বিশেষজ্ঞ ফ্রাঙ্ক ও ডোনেল এবং অ্যালেক্স বলফ্রাস বলফ্রাস এনিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। পরিসংখ্যায় উঠে আসে এলএসি বরাবর চিনের মোকাবিলায় ভারত অন্তত ২ লাখ ২৫ হাজার সেনা মোতায়েন করতে সক্ষম। তার মধ্যে উত্তরাঞ্চলীয় কমান্ডে সেনা সংখ্যা প্রায় ৩৪ হাজার। এই মুহূর্তে লাদাখে রয়েছে ৭২টি ব্রিগেডের ১৫০টির মতো ট্যাঙ্ক এবং ৩০০০ বাহিনী। তারসঙ্গে রয়েছে অষ্টম মাউন্টেন ডিভিশন এবং তৃতীয় ইনফ্রান্টির সেনারা।

১৬,০০০ হাজার সেনা রয়েছে মধ্যাঞ্চলীয় কমান্ডের ষষ্ঠ মাউন্টেন ডিভিশনের। পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধীনে চীনা সীমান্তে ভারতীয় সেনার ৯টি মাউন্টেন ডিভিশনের রয়েছে ১ লাখ ৭৫ হাজার সেনা। তার সাথে রয়েছে অরুণাচলের ব্রহ্মস মিসাইল রেজিমেন্ট।

বিপরীতে চীনের শিনচিয়াং মিলিটারি ডিস্ট্রিক্ট এবং তিব্বত মিলিটারি ডিস্ট্রিক্টে মোতায়েন রয়েছে ৭০,০০০ হাজার সেনা। এই সৈন্য সংখ্যার অধিকাংশ সীমান্ত রক্ষী বাহিনী। এর সঙ্গে চিনের ওয়েস্টার্ন থিয়েটার কমান্ডের প্রায় ১ লক্ষ ২০,০০০ গোলন্দাজ আর পদাতিক সৈন্য মিলিয়ে দিলে তা ভারতের সেনা সমাবেশের প্রায় সমান হবে।

সিএনএস রিপোর্ট বলছে, পদাতিক বা গোলন্দাজ বাহিনী দক্ষতায় ভারতীয় বাহিনী অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে চীনের তুলনায়। তার কারণ হিসাবে বলা হচ্ছে ভারতীয় বাহিনী নিয়মিত সন্ত্রাস দমনের সঙ্গে যুক্ত থাকায় যুদ্ধ মোকাবিলায় সে অনেকবেশি দক্ষ। এছাড়াও ১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধে দুর্গম পরিবেশে জয়লাভ করে ভারতীয় বাহিনী অনেক বেশি অভিজ্ঞ। অন্যদিকে ১৯৭৯ সালে ভিয়েতনামের সঙ্গে সংঘর্ষ ছাড়া চীনের বাহিনী বড় কোন সংঘর্ষের মুখোমুখি হয়নি। ওই যুদ্ধে অর্থাৎ ভিয়েতনামের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল চীনা বাহিনী।

ভারতীয় সেনাবাহিনী নিয়মিত তার সমরাস্ত্রের শক্তি বাড়িয়েছে। চিনুক অ্যাপাশের মতো হেলিকপ্টার যা দুর্গম এলাকায় যুদ্ধের পক্ষে উপযুক্ত তা ভারতীয় বাহনীতে যুক্ত হওয়ায় বেড়েছে ক্ষমতা। সেই সঙ্গে সি ১৩০ জে সুপার হারকিউলিস এবং সি ১৭ গ্লোবমাস্টারের মতো বিমান প্রত্যন্ত এলাকায় বাহিনীর রসদ জোগানো এবং সাপোর্ট পৌঁছে দিতে পারে।

ভারত ও চিনের বিমান বহরের ক্ষমতা
বিমান বহরের ক্ষেত্রেও চীনের থেকে এগিয়ে রয়েছে ভারত পরিসংখ্যান অনুযায়ী। চীন ভারত নিয়ন্ত্রণ রেখা অংশটি চীনের পশ্চিমাঞ্চলের কমান্ডের অন্তর্ভুক্ত। এর অধীনে রয়েছে ১৫৭টি যুদ্ধবিমান। রয়েছে ড্রোন। এই যুদ্ধখস্ত্রের অধিকাংশ রয়েছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে মোকাবিলার জন্য। ভারত বিমান বাহিনীর উত্তারঞ্চলীয় মধ্য এবং পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের ২৭০টি যুদ্ধ বিমান এবং ৬৮টি গ্ৰাউন্ড অ্যাটাক এয়ারক্রাফট ব্যবহার করতে পারে। মারণ ক্ষমতায় ভারতের চতুর্থ প্রজন্মের ফাইটারের সংখ্যা চীনের তুলনায় এই অংশে বেশি। মিরাজ ২০০০, চীনের জে ১০ এবং জে ১১ ফাইটার বিমানগুলির সমকক্ষ। সুখোই ৩০ চীনের চতুর্থ প্রজন্মের থেকে অনেকবেশি শক্তিশালী। লজিস্টিক বা অবস্থানগত ভাবেও ভারত চীনের থেকে এগিয়ে।

চিনের বিমানঘাঁটিগুলি প্রত্যেকটি তিব্বত এবং জিংজিয়াং অত্যন্ত উঁচু এলাকায় অবস্থিত। যেখানে বাতাসের ঘনত্ব খুব কম। এখানে চিনা বিমান বহর খুব অল্প পরিমাণে যুদ্ধাস্ত্র বহন করতে পারে। এই ধরনের ৮টি বিমানঘাঁটি রয়েছে চীনের। চিনের হাতে যে ১৫টি ট্যাঙ্কার বিমান রয়েছে যা দিয়ে আকাশে বিমানে জ্বালানি ভরা সম্ভব তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেকটাই কম। অন্যদিকে লাদাখ ও অরুণাচলের সীমান্তরেখায় যেসব বিমানঘাঁটিগুলো রয়েছে যা অবস্থানগত দিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থায় রেখেছে ভারতকে।

চীনা পাইলটদের থেকে ভারতীয় বাহিনী প্রতিকূল পরিবেশে যুদ্ধ করতে অনেকবেশি সক্ষম। ফাইবার গ্লাস শিট এবং দ্রুত জমাট বাঁধতে পারে এমন রিইনফোরস কংক্রিটের সাহায্যে যে কোন ক্ষতিগ্ৰস্ত রানওয়েকে ৬ ঘন্টার মধ্যে ব্যবহারে প্রস্তুত করে তোলার ক্ষমতা রয়েছে ভারতের।

নৌবাহিনী যুদ্ধ শুরু হলে ভারতীয় নৌবাহিনীও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এই মুহূর্তে ১৩৭টি যুদ্ধজাহাজ এবং ২৯১টি বিমান রয়েছে ভারতীয় নৌবহরের অধীনে। আছে পরমাণু চালিত সাবমেরিন। সেই সঙ্গে ভারত মহাসাগরে যেকোন যুদ্ধ জাহাজের গতিবিধির তথ্য পায় ভারত, উপগ্ৰহের মাধ্যমে। এছাড়াও দক্ষিণ চীনা সাগরে ভারত তার উপস্থিতি বাড়িয়ে তুলেছে। নজর রাখছে আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জকে কেন্দ্র করে সঙ্কীর্ণ মলাক্কা প্রণালীতে। এই প্রণালী চীনের সবচেয়ে দুর্বল অংশ। দক্ষীণ চীনা সাগরে চীন সবচেয়ে বেশি প্রতিকূলতার মুখে এখন। এই এলাকায় মার্কিন নৌবহর তার শক্তি বৃদ্ধি করছে।

দুই দেশ পরমাণু শক্তিধর। চীন ভারতীয় ভূখন্ডের বিভিন্ন প্রান্তে ১০৪টির বেশি পরমাণু বোমাবাহী ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়তে পারে। চীনের হাতে রয়েছে স্বল্প পাল্লার ভূমি থেকে ভূমি, আকাশ থেকে ভূমির মতো ক্ষেপণাস্ত্র। ভারতের যে ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে সেগুলোর সবটাই পাকিস্তানমুখী। তবে ভারতের ১০টি অগ্নি, ৩ মিসাইল চিনের মূল ভূখণ্ডে যে কোন মুহুর্তে আঘাত হানতে পারে।

তবে পরমাণু বোমা বহনকারী দুই স্কোয়খড্রন জাগুয়ার আইএস ফাইটার ও মিরাজ ২০০০ চীনের মূল ভূখণ্ডে পৌঁছাতে অক্ষম। এই ক্ষেত্রে চিন ভারতের থেকে অনেকটা এগিয়ে রয়েছে বলে বেলফারের রিপোর্ট বলছে।

জিডিপি বিচারেও চীনের সামরিক বাহিনীর জন্য বরাদ্দ ভারতের থেকে বেশি। চীনের মূল প্রতিপক্ষ আমেরিকা। এছাড়াও জাপান, ফিলিপিন্স, তাইওয়ান বা রাশিয়ার জন্য যতটা প্রস্তুত ভারতের জন্য ততটা প্রস্তুত নয় চীন।
চীনের এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় শক্তি সাইবার আর্মি। রয়েছে দ্বিতীয় বৃহত্তম ড্রোনের ব্যবহার। চীন চিরাচরিত যুদ্ধের চেয়ে অনেকবেশি অচিরাচরতি যুদ্ধে স্বচ্ছন্দ।

চীন যেমন নেপাল, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বন্ধুত্ব বাড়িয়ে তুলছে তেমন ভারত জাপান, মঙ্গোলিয়া, ভিয়েতনামের মতো চীনের প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বাড়াচ্ছে। এছাড়াও আমেরিকা ও রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের ভালো সম্পর্ক চীনের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে উঠতে পারে। ছায়া অথবা পুরোদস্তর যুদ্ধে কোনটাতেই সহজে ভারতকে হারানো সম্ভব নয় বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।