নিজস্ব প্রতিবেদন : কবিগুরু বলেছিলেন ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’। এই কথার মধ্যে এক মহৎ দর্শন লুকিয়ে আছে। উদ্দেশ্য যদি মহৎ হয়, তাহলে সাহসের উপর ভর করে সেই কাজে একাই এগিয়ে যাওয়া যায়, কাউকে পাশে পেলে তা উপরি পাওনা। কিন্তু সৎকার্য, মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে করা কার্য,যত কঠিনই হোক না কেন তা একদিন সফল হবেই। তাই এই সকল ক্ষেত্রে কাউকে সঙ্গী না পেলে একাই এগিয়ে যাওয়া উচিত। ঠিক যেমনটা করলেন বিহার রাজ্যের লাউঙ্গি ভুঁইয়া।
গ্রামের সকল মানুষ যখন সমস্যার কথা ভেবেছেন, সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন, তিনি তখন সকলের মধ্যে ব্যতিক্রম। তিনি ভেবেছেন সমাধানের কথা। আর সমাধানের পথ খুঁজে বার করে সে পথে একাই এগিয়ে গেছেন।
বিহারের গয়া থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরের গ্রাম কোঠিলাওয়া। গ্রামে জল সমস্যা এতোখানি ভয়াবহ যে বর্ষার সময় ছাড়া জল পাওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।অপরদিকে গ্রামের জীবিকা বলতে শুধু চাষবাস আর পশু পালন। এত জল সমস্যার কারণে সেই জীবিকা নির্বাহেরও অসুবিধা রয়েছে। এই সমস্যার জন্যই অনেক মানুষই গ্রাম ছেড়েছেন, পাড়ি দিয়েছেন শহরে। কিন্তু কেউ কখনও সমাধানের কথা ভাবেননি।
কোঠিলাওয়া গ্রামের লাউঙ্গি ভুঁইয়া ছোট থেকে বড় হয়েছেন এই জল সংকটের মধ্য দিয়েই। ছোট থেকে এই সমস্যা চোখে দেখার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের প্রবীণ মানুষদের মুখে শুনেও এসেছেন এই প্রসঙ্গে বিস্তর আলোচনা। কিন্তু কেউ কখনও উদ্যোগী হননি এর সমাধান করার জন্য, এক লাউঙ্গি ভুঁইয়া ছাড়া। তিনি প্রথম সমাধানের কথা ভেবেছিলেন।
গ্রামের কাছে পাহাড় বেয়ে বৃষ্টির জলে পুষ্ট এক নদী ছিলো। সেই জল যদি সরাসরি গ্রামে পৌঁছায় তাহলে জল সমস্যার সমাধান হবে। এই কথা মাথায় আসতেই খাল কাটার জন্য উদ্যোগী হয়ে ওঠেন তিনি। সকলে যখন এক এক করে গ্রাম ছেড়ে শহরে পথে পাড়ি দিচ্ছেন, তখন লাউঙ্গি বাবু গবাদিপশু চড়ানোর সময় কোদাল দিয়ে মাটি কেটেছেন দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। আর দীর্ঘ ৩০ বছরে এই একই কাজ করে গেছেন তিনি। অবশেষে তিনি সক্ষম হয়েছেন ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি খাল কেটে গ্রামের জল সমস্যার সমাধান করতে। দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে এই কাজ একাই তিনি করেছেন ক্লান্তিহীনভাবে। আর তাই তার একার প্রচেষ্টায় আজ গোটা গ্রামের জল সমস্যার সমাধান হলো।
লাউঙ্গি বাবুর কথায়, “গত ৩০ বছর ধরে আমি রোজ পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে গবাদিপশু চরাতে যেতাম। গবাদি পশুদের ছেড়ে দিয়ে শুরু হতো আমার কাজ। প্রতিদিন কোদাল দিয়ে মাটি কাটতাম আমি। গ্রামের কোন ব্যক্তি আমার সঙ্গে কখনো যোগ দেয়নি অনেকেই জলের সমস্যার জন্য গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে গেছেন। তবে ভিটেমাটি ছেড়ে আমি যেতে চাইনি কখনো।”
খাল কাটার কথা কীভাবে মাথায় এলো এই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে লাউঙ্গি বাবু বলছেন, “প্রতি বছর বর্ষার মরসুমে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে বৃষ্টির জল নদীতে নামতে দেখতাম। তখনই মাথায় আসে যদি একটা খাল কাটা যায় তাহলে এই সমস্যার হয়তো একটা সমাধান হবে সেই ভাবনা থেকেই কাজ শুরু করি।”
Bihar: A man has carved out a 3-km-long canal to take rainwater coming down from nearby hills to fields of his village, Kothilawa in Lahthua area of Gaya. Laungi Bhuiyan says, "It took me 30 years to dig this canal which takes the water to a pond in the village." (12.09.2020) pic.twitter.com/gFKffXOd8Y
— ANI (@ANI) September 12, 2020
আর আজ তিনি তার কাজে সফল। ৩০ বছরের একার নিরলস এই প্রচেষ্টা করেছেন তিনি গোটা গ্রামের কথা ভেবে। তার এই আত্মত্যাগ প্রসঙ্গে ঐ গ্রামের একজন বাসিন্দা বলেন, “তার নিরলস পরিশ্রমের সুফল ভোগ করবে গোটা গ্রাম। চাষের পাশাপাশি গ্রামের মানুষের জল খাওয়ার সমস্যা ও মিটবে, গবাদি পশুদের জলের সমস্যা ও মিটবে। নিজের কথা না ভেবে উনি আমাদের কথা ভেবেছেন, আমাদের গ্রামের কথা ভেবেছেন। অথচ উনি চাইলেই শহরে গিয়ে একটা আয়েশী জীবন কাটাতে পারতেন, কিন্তু তা উনি করেননি।”
আসলে ভুঁইয়া বাবুর মত মানুষরা এইরকমই হন, যারা শুধু নিজের জন্য নয় ‘বহুজনহিতায়’ নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করেন।