নিজস্ব প্রতিবেদন : সম্প্রতি Rap গায়ক বাদশা ও পায়েল দেব একটি নতুন মিউজিক ভিডিও লঞ্চ করেন। যেখানে তারা রতন কাহারের বিখ্যাত লোকসঙ্গীত ‘বড়লোকের বিটি লো লম্বা লম্বা চুল’ গানটি ব্যবহার করেন। কিন্তু এখানে গানের স্রষ্টা রতন কাহারের নামটি উল্লেখ করেননি কোথাও। এই মিউজিক ভিডিও সোনি মিউজিক ইন্ডিয়া। এই মিউজিক ভিডিওর গানে প্রধান মুখ হিসেবে দেখা গিয়েছে অভিনেত্রী জ্যাকলিনকে। মিউজিক ভিডিও লঞ্চ করার প্রথম দিনে ১ কোটি মানুষ এই ভিডিওটি দেখে ফেলেছেন। এই মিউজিক ভিডিও দিয়ে শুরু হয় প্রচুর টাকা কমানো, কিন্তু কোথাও নেই রতন কাহারের নাম। এই নিয়ে বাদশা ও সোনি মিউজিক ইন্ডিয়াকে অনেক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়, অনেকেই বলতে শুরু করেন, রয়্যালটির টাকা যাতে রতন কাহারকে দিতে না হয় সেই কারণে সুকৌশলে তারা এই নামটি এড়িয়ে গেছেন।
এরপর কয়েকদিন ধরে নেটিজেনদের মধ্যে এই ভিডিও নিয়ে নানারকম কথাবার্তা শুরু হয় এবং রতন কাহারের নামটি এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বা উল্লেখ না করার জন্য বাদশাকে অনেকভাবে কথাবার্তা শুনতে হয়, সমালোচনা ও ক্ষোভের মুখে পড়তে হয়। রতন কাহারের একটি ভিডিও সাক্ষাৎকার নিয়ে লঞ্চ করা হয়। ১৯৭৬ সালের স্বপ্না চক্রবর্তীর গাওয়া গানে এবং অন্যান্য যে সমস্ত জায়গায় এই গান ব্যবহার করা হয়েছিল সেখানেও কিন্তু রতন কাহারের নাম দেওয়া হয়নি সে কথা উল্লেখ করে নানা লেখালেখি করা হয়। রতন কাহার এমন একজন মানুষ যিনি কোনো অর্থ চান না, তিনি শুধু চিরকাল চেয়েছেন তার স্বীকৃতিটুকু! কিন্তু পাননি অভাবের সংসার যেখানে দিন আনি দিন খেয়ে, বিড়ি বেঁধে তার দিন গুজরান হয় সেখানে কোর্ট কেস লড়বেন এত অর্থ তার নেই তাই হেরে গেছেন তিনি! আজ তার সংসারের এতোটুকু সামর্থ্য নেই যে তিনি তার মেয়েকে একটা হারমোনিয়াম কিনে দিতে পারেন! চার ছেলে মেয়ের কেউই যার মাধ্যমিক পাশ করতে পারেননি অভাবের কারণে। অথচ এই মানুষটি লেখা গান গেয়ে অনেকেই আজ বিখ্যাত কোটি কোটি টাকা কামাচ্ছেন। এই চির বঞ্চিত মানুষটিকে নিয়ে নতুন করে লেখালেখি শুরু হয় বাদশা এবং পায়েল দেবের মিউজিক ভিডিওটি আসার পর।
ভিডিওটিতে রতন কাহার বলেছেন যে, “আমি লিখেছিলাম বড়লোকের বিটিলো। সুর, শব্দ, গানের সবকিছুই আমার। এখন মানুষ যদি অসৎ হয়! তাহলে আমি কিবা করতে পারি! আমি খুবই গরীব। অনেক মানুষই আমার গান নিয়েছেন। কিন্তু কেউই কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেননি। ওরা নিজেরা গান লিখতেই জানেন না। আমার গানকেই ওরা নিজের গান বলে চালায়। আমি কুঁড়েঘরে থাকি। মাটির গান লিখি। ওদের কোর্ট অবধি টেনে নিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য আমার নেই!”
রতন কাহারের সম্বল বলতে ছিল দু’চারটে অনুষ্ঠানের বাজারে যা আজ বন্ধ হতে চলেছে। এই তুমুল অভাবের মধ্যে তিনি লড়াই করে চলেছেন আজও। তার কথায়, “প্রথম থেকেই বঞ্চনার শিকার আমি। অনেক সময় ভেঙে পড়েছি। পাশে কেউ দাঁড়ায়নি। আজও আমার পাশে কেউ নেই। অবজ্ঞার শিকার হয়েছি বার বার। মা সরস্বতীর কৃপায় যতটুকু পেরেছি মানুষকে আনন্দ দিতে গান লিখেছি।”
রতন কাহারের ছেলের কথায়, “বাবার সাথে অনেক জায়গায় গিয়েছি। অনেক অনুষ্ঠানে। বাবাকে সকলেই সম্মান করেন। কিন্তু দুঃখ একটাই বাবা কোনো সুযোগ পেলোনা অথচ বাবার গান গেয়ে সকলেই বড়লোক হয়ে গেলো।”
সমালোচনার মুখে পড়ে বিধ্বস্ত বাদশা অবশেষে একটি ভিডিও পোস্ট করেন যেখানে তিনি বলেন, “তার মিউজিক ভিডিওটি লঞ্চ করার সময় তিনি দুটি লাইন নিয়েছিলেন বাংলা লোকসংগীত থেকে। এই লাইন দুটি নেওয়ার সময় তিনি বিভিন্ন রকম ভাবে তথ্য ঘেঁটেছিলেন। কিন্তু কোথাও রতন কাহারের নাম উল্লেখ ছিল না। এটি একটি লোকসংগীত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল এটি বাংলার লোকসঙ্গীতের একটি অংশ। তাই তিনিও রতন কাহারের নাম উল্লেখ করেননি। তিনি যদি কোন জায়গায় রতন কাহারের নাম পেতেন তাহলে তিনি নিশ্চয়ই সেটি উল্লেখ করতেন।”
কিন্তু মিউজিক ভিডিওটি লঞ্চ করার পর তাকে বহু মানুষ ট্যুইট করে বহু মানুষ লেখা পোস্ট করে জানান ওই গানটি রতন কাহারের লেখা। একজন আর্টিস্ট হিসেবে তিনি আর্টিস্টের সম্মান করতে জানেন এবং সেই কারণে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে তিনি রতনকে সাহায্য করবেন। তিনি বলেন, “যে বা যারা রতন কাহারের শুভাকাঙ্ক্ষী হিতাকাঙ্খী আছেন তারা যেন তাকে নিয়ে তার কাছে যায় তিনি অবশ্যই তাকে সাহায্য করবেন এটা একজন আর্টিস্ট হিসেবে আর্টিস্টের প্রতি প্রণাম।”
এই ভিডিওটিতে তিনি আরও বলেছেন, “তিনি নিজে একজন পাঞ্জাবি। তিনি কালচারকে খুব ভালোবাসেন। কালচারকে সম্মান করেন তিনি সে বাঙালি কালচারই হোক, গুজরাটি অথবা পাঞ্জাবি কালচারই হোক।” তিনিই ভিডিওটিতে বারংবার বলেন, পূর্ববর্তী কোন রেকর্ডে রতন কাহারের নাম উল্লেখ থাকলে তিনি অবশ্যই রতন কাহারের নামটি তিনি উল্লেখ করতেন। ইচ্ছাকৃত সুকৌশলে তিনি এটি এড়িয়ে যাননি। কিন্তু এত মানুষের বক্তব্য শোনার পর তার মনে হচ্ছে যে একজন আর্টিস্ট হিসেবে তার একটি কর্তব্য আছে অপর আর্টিস্টের প্রতি। তাই যতভাবে সম্ভব সমস্ত ভাবেই তিনি রতন কাহারকে সাহায্য করতে প্রস্তুত!
বাদশা আরও বলেছেন, “রতন কাহার সাহেব আমার সাধ্যমত আমি আপনাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত।”
আমরা অপেক্ষা করে আছি একজন চিরবঞ্চিত মানুষের কপালে স্বীকৃতি দেখতে পাবো বলে। একজন শিল্পী তার যোগ্য সম্মান পান এই দৃশ্য দেখব বলেই আমরা আজ অপেক্ষারত!