চিন বসিয়েছে এস-৪০০ মিসাইল সিস্টেম, মোকাবিলায় কতটা প্রস্তুত ভারত

নিজস্ব প্রতিবেদন : ১৯৬২ সালে ভারত চিন সীমান্ত যুদ্ধ হয়েছিল। তারপর দীর্ঘ কয়েক বছর সীমান্ত নিয়ে ভারত চিনের মধ্যে টানাপোড়েন চললেও পারস্পরিক আলোচনা ও বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে সংঘাতকে এড়ানো সম্ভবপর হয়।

কিন্তু চলতি বছরের জুন মাসে পূর্ব লাদাখের গাল‌ওয়ান উপত্যকায় ভারত চিন সীমান্ত যুদ্ধে ভারতীয় সেনার ২০ জন জ‌ওয়ান শহীদ হলে ভারত-চিন সীমান্ত সংক্রান্ত মনোমালিন্য রক্তক্ষয়ী সংঘাতের রূপ নেয়। এরপর ভারত সরকার একদিকে চিনা দ্রব্য বয়কট করে চিনকে অর্থনৈতিক ভাবে চাপে ফেলার কৌশল অবলম্বন করে। অপরদিকে রণংদেহি মূর্তিতে ভারত সেনাকে প্রস্তুত করতে থাকেন। চীনের মার্শাল আর্ট বাহিনীর প্রত্যুত্তরে ভারত ও ঘাতক কম্যান্ডো বাহিনী মোতায়েন করে সীমান্তে। ভারত সরকার পূর্ব সীমান্তে আকাশসীমাকে সুরক্ষিত করার জন্য কিছু কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহণ করলে, চীনও পাল্টা প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। রাশিয়ার থেকে নিয়ে আসা এস-৩০০ ও এস-৪০০ মিসাইল সিস্টেম মোতায়েন করে চিন।

ভারতের অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ডঃ জি ডি বক্সির কথায়, “ভারতীয় বায়ুসেনার অভূতপূর্ব ‌কৌশলী পদক্ষেপ দেখেই চীনের বায়ু সেনা এস-৩০০ ও এস-৪০০ এয়ার ওয়েপেন সিস্টেম মোতায়েন করেছেন।” তবে চীনের এই এস-৪০০ মেসাইল সিস্টেমকে মোকাবিলা করতে‌ ভারতও প্রস্তুত রয়েছে।

এস-৪০০ মোকাবিলায় আকাশ সীমাকে সুরক্ষিত করতে কী কী প্রস্তুতি আছে ভারতের?

ভারতের আকাশসীমাকে সুরক্ষিত করতে এয়ার ডিফেন্স মিসাইল সিস্টেম মোতায়েন করেছে কেন্দ্র সরকার। ২৪ ঘন্টা ভারতের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় পাখির চোখের মতন নজর রেখে চলেছে ভারতীয় বায়ুসেনার অসংখ্য কমব্যাট ফাইটার এয়ারক্রাফট।

ভারত-চীন সীমান্ত সংঘর্ষের আগে থেকেই ভারত সরকার সীমান্তকে সুরক্ষিত করে রেখেছে। লাদাখের সীমান্তে ৯০ টি ভীষ্ম ট্যাঙ্ক মোতায়েন করা আছে। এই ট্যাঙ্কগুলি রাশিয়ার থেকে কেনা। এর সাহায্যে ৬০ সেকেন্ডে‌‌ ৮টি সেল ছোড়া যায়। রাশিয়ার কাছ থেকে এই ট্যাঙ্কগুলি কেনার পর ভারত এগুলিকে আরও উন্নত করা হয় এর মধ্যে এক্সক্লুসিভ রিঅ্যাক্টিভ আর্মার লাগিয়ে। এর ফলে এটি আগের থেকে আরও উন্নত হয়ে গেছে। এর ফলে দিন অথবা রাতের যে কোনো প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যেই এই ট্যাঙ্কগুলি থেকে যেকোনো পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা সম্ভব।

এই ৯০ টি ভীষ্ম ট্যাঙ্ক ছাড়াও সুখোই-৩০ ফাইটার জেট আছে যা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ইঞ্জিন মাল্টিরোল এয়ার সুপিরিয়রটি ফাইটার জেটগুলির মধ্যে একটি।

সুখোই-৩০ ছাড়া আর কী কী ফাইটার জেট আছে ভারতের কাছে?

সুখোই-৩০ ছাড়া মিরাজ-২০০০, মিগ-২৯‌ ফাইটার জেটের নয়া ভার্সনের যুদ্ধবিমান প্রস্তুত করে রাখা আছে সীমান্তে। এছাড়া স্কোয়াড্রন মিগ-২৯‌ ফাইটার জেট আছে ভারতের হাতে যার গতি ঘন্টায় ২৪২৫ কিলোমিটার।

সীমান্তকে সুরক্ষিত রাখতে এ এইচ ৬৪, সি এইচ ৪৭, এফ চিনুক মাল্টি মিশন হেলিকপ্টারও মোতায়েন করে রেখেছে ভারতীয় বায়ুসেনা।

লাদাখের সীমান্তে টহল দেওয়ার কাজে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে ভারতের পক্ষ থেকে?

চীনের মোকাবিলা করতে ‘অ্যানম্যানড এরিয়াল ভেহিকেল’, হেরন টিপি ড্রোনের মতো সশস্ত্র দূরপাল্লার ড্রোন মোতায়েন করা হয়েছে সীমান্তে। প্রতিমুহূর্তে এই সশস্ত্র ড্রোনগুলি টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে সীমান্তে।এই ড্রোনগুলির সাহায্যে যেমন অনায়াসেই শত্রুপক্ষকে টার্গেট করা যাবে তেমনি এর মধ্যে থাকা বিশেষ ক্যামেরার সাহায্যে প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যেও শত্রু ঘাঁটির ছবি তুলে আনা সম্ভব হবে।

প্রস্তুতির দিক থেকে চীন না ভারতকে এই মুহূর্তে এগিয়ে?

অবসরপ্রাপ্ত মেজর জি ডি বক্সি জানিয়েছেন, ভারতীয় সেনা ও বায়ু সেনা চীনা বাহিনী থেকে অনেকটাই এগিয়ে আছে।

কোন কোন দিক থেকে এগিয়ে আছে ভারত?

অবসরপ্রাপ্ত মেজরের বক্তব্য অনুযায়ী ১৪ হাজার থেকে ১৬ হাজার ফুট উচ্চতায় গাল‌ওয়ান উপত্যকায় যুদ্ধের অস্ত্র মোতায়ন করা ও রণকৌশল-এই দুটি দিক থেকেই ভারত চীনের থেকে অনেক অনেক বেশী এগিয়ে রয়েছে।

যুদ্ধ ক্ষেত্রে চীনের পিছিয়ে থাকার পেছনে কারণ কী?

ভারত চীন সীমান্ত যুদ্ধে চীনের পিছিয়ে থাকার পিছনে সবথেকে বড় কারণ হল দূরত্ব। চিনা বাহিনীকে যেখানে অনেক দূর দূর থেকে সামরিক সরঞ্জাম বয়ে আনতে হবে গাল‌ওয়ান উপত্যকায়, ভারত সেখানে হাতের কাছেই সব সরঞ্জাম পাবেন।কারণ পূর্ব লাদাখের কাছেই রয়েছে পাঞ্জাব হরিয়ানা, কাশ্মীর ও লেহ। এই সকল জায়গাগুলিতেই ভারতের একাধিক এয়ারবেস রয়েছে। ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রয়োজনমত খুব সহজেই সামরিক সরঞ্জাম কপ্টারে করে আনা যাবে।

সামরিক সরঞ্জাম যোগানের সুবিধা ছাড়া আর কোন দিক থেকে এগিয়ে আছে ভারত?

প্রস্তুতির দিক থেকে ভারত অনেকটাই এগিয়ে। কারণ ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রায়ই চিনা ফৌজ একরকম জোর পূর্বক দখলদারি করে এসেছে। তাই ভারত চীন সীমান্ত সংঘাত হলে মোকাবিলা কীভাবে করতে হবে এর প্রস্তুতি অনেক আগে থেকেই ভারতীয় সেনা নিয়ে রেখেছে।

এছাড়া ভারতীয় বায়ুসেনার সামরিক শক্তি ও স্থলবাহিনীর ঘাতক মাউন্টেন ফোর্সের শক্তির প্রশংসা চীনা বাহিনীও করে। এছাড়া পূর্ব লাদাখে এয়ার ডিফেন্স মিসাইল সিস্টেমকে নিযুক্ত করে রেখেছে ভারত। সীমান্তকে সবদিক থেকে সুরক্ষিত করতে ‘কুইক রিয়াকশন সারফেস টু এয়ার মিসাইল সিস্টেম’ও‌ মোতায়েন করেছে। এম-১০৭, এম-৭৯৫, ই আর এফ বি, এম ৯৮২ এই চার ধরনের গোলা যুক্ত এম-৭৭৭ আল্ট্রা লাইট হাউজার কামান ও প্রস্তুত রেখেছে ভারত। প্রসঙ্গত, এই কামানটি আমেরিকার থেকে কেনা। এই কামান‌ ২৪ থেকে ৪০ কিলোমিটার রেঞ্জ অবধি ভারী গোলাবর্ষণ করতে সক্ষম।

এছাড়া ৬টি রাফাল ফাইটার জেট ভারত কিনেছে ফ্রান্সের থেকে। এই ফাইটার জেটগুলি যুদ্ধ জাহাজ ধ্বংস করতে মিসাইল নিক্ষেপ করতে অনেক উঁচু থেকে হামলা চালাতে সক্ষম। একই সাথে এই ফাইটার জেটের সাহায্যে পরমাণু হামলাও চালানো সম্ভব।

এছাড়া খুব শীঘ্রই ভারতের হাতে আসতে চলেছে ‘মেটিওর’ ও ‘স্কাল্প’ নামের দুটি শক্তিশালী মিসাইল। লক্ষ্য সীমার বাইরে থাকা শত্রুকেও নিখুঁতভাবে আঘাত হানতে সক্ষম মিসাইল মেটিওর। ১২০ কিলোমিটার দূরে শত্রু ঘাঁটি থাকলেও তাকে আঘাত করতে পারবে এই মিসাইল। ‘স্কাল্প’ মিসাইলটি ৬০০ কি মি পাল্লা অবধি লক্ষ্য টার্গেট করতে সক্ষম।

নিজেকে আরও শক্তিশালী করতে এস ৪০০ মোকাবিলা করতে ভারত আর কী কী অস্ত্রের আমদানি করতে চলেছে?

ভারত রাশিয়ার থেকে আরও ১২ টি সুখোই ৩০, ২১ টি মিগ ২৯ কিনতে চলেছে। এছাড়াও রাশিয়ার থেকে এস-৪০০ অ্যান্টি এয়ারক্রাফট ওয়েপেন সিস্টেম তথা সারফেস টু এয়ার মিসাইল সিস্টেম কিনতে চলেছে ভারত। এই অত্যাধুনিক এয়ারক্রাফট মুহুর্তের মধ্যে ধুলিস্যাৎ করে দেবে শত্রু ঘাঁটি। মাটি থেকে আকাশে‌ যে কোনো লক্ষ্যবস্তুকেই আঘাত করতে সক্ষম অত্যাধুনিক এই এয়ারক্রাফট। ২০২১ সালের মধ্যেই ভারতের হাতে আসতে চলেছে এস ৪০০ ট্রায়াম্ফ। এই মুহূর্তে রাশিয়ায় উন্নত প্রযুক্তির বিমানবিধ্বংসী ও ক্ষেপণাস্ত্রবিধ্বংসী এয়ারক্রাফটের মধ্যে এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ অন্যতম। এই কমব্যাট ফাইটার এয়ারক্রাফট ৬০০ কিলোমিটার দূরে থাকা লক্ষ্যবস্তুতেও আঘাত হানতে পারে নিখুঁতভাবে।

এস-৪০০ ট্রায়াম্ফের সবথেকে বড় বিশেষত্ব হলো এটি একই সাথে ৩০০টি লক্ষ্য বস্তুর দিকে নজর রাখতে সক্ষম এবং এই এয়ারক্রাফটি একই সাথে ৩৬টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ৩৬টি আলাদা আলাদা লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করতে পারে। এর গতি হলো পার সেকেন্ডে ৪.৮ কিমি। এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তির এয়ারক্রাফটের পাঁচটি ইউনিট কিনতে ভারত সরকার ৩৯০০ কোটি টাকা খরচ করেছে। দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও জোরদার করে তুলতে এই ক্ষেপণাস্ত্রটির দিকেই আপাতত নজর রেখেছেন ভারত সরকার। এই ক্ষেপণাস্ত্রটি ভারতে এলে আগামী দিনে ভারতের প্রতিরক্ষা বিভাগ আরও মজবুত হয়ে উঠবে আশা করা যায়।