৩০০ চীনা সেনার বিরুদ্ধে একা লড়াই করে অমরত্ব পেয়েছিলেন যশোবন্ত সিং

নিজস্ব প্রতিবেদন : মানুষ তার কর্মের দ্বারা, বীরত্বের দ্বারাই অমরত্ব লাভ করে। ঠিক যেমন ভারতীয় সেনাবাহিনীর যশোবন্ত সিং তার লড়াইয়ের জন্য অমর হয়ে আছেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর এই জওয়ানের নম্বর ৪০৩৯০০৯। তাঁর বয়স ছিল ২১ বছর। অরুনাচল তাওয়াং সীমান্তের প্রহরায় ছিলেন যশোবন্ত।

১৯৬২ সালের নভেম্বর মাসে ভারত ও চিনের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। ১৭ই নভেম্বর ভোর পাঁচটা নাগাদ অরুণাচল প্রদেশের সেলাতে চিনাদের দুটি ব্যাটেলিয়ান পুনরায় ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করে। উল্লেখ্য এটি ছিল চতুর্থ নম্বর যুদ্ধ। এর আগেও তিনবার চিনা সেনারা ভারতকে আক্রমণ করেছিল অরুণাচল প্রদেশকে দখল করার লক্ষ্যে। কিন্তু প্রতিবারই অসম্ভব যুদ্ধ করে ভারতীয় সেনারা মাটি কামড়ে পড়েছিল। তাই ভারতের কোন অংশই চিনারা দখল করতে পারেনি।

ভারতীয় বাহিনীর ১০০ মিটার দূরত্ব থেকে মিডিয়াম মেশিনগান চালাতে থাকেন চিনা সৈন্যরা। চীনাদের সেই মিডিয়াম মেশিনগানের সামনে ভারতীয় সৈন্যরা লাইট মেশিনগান চালাবার সুযোগই পাননি। ভারতীয় সেনাদের মধ্যে ততক্ষণে বেশ কয়েকজন সেনা শহীদ হয়ে গেছেন। চিনাদের ওই মেশিনগান থামানোর জন্য রণকৌশল কষতে বসেন ভারতীয় সৈন্যদের দায়িত্বে থাকা সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট এসএন টন্ডন।

চিনাদের উপর পাল্টা আক্রমণ করবার দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেন তিনজন জাওয়ান- লান্স নায়েক ত্রিলোক সিংহ নেগি, রাইফলেনম্যান গোপাল সিংহ গুসেইন ও রাইফেলম্যান যশোবন্ত সিং। অভূতপূর্ব কৌশলে তারা তিনজন চীনা সেনাদের নজর এড়িয়ে পাথর ও ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে চিনা সৈন্যদের ১০ থেকে ২২ গজের মধ্যে পৌঁছে যান। গোপাল সিংহ ও যশোবন্তকে কভার ফায়ার করতে থাকেন ত্রিলোক সিংহ। তিন চিনা সেনাকে মেরে ২ ভারতীয় সেনা মেশিনগান নিয়ে ফিরছিলেন এমন সময় গুলির আঘাতে ত্রিলোক সিংহের মৃত্যু ‌হয়। গুলিতে আহত হয়ে গোপাল সিংহ কোনমতে নিজেদের ট্রেঞ্চে ফিরে আসতে সক্ষম হন। কিন্তু‌ চিনাদের মিশন গান তখন ভারতীয়দের দখলে। ১৫ মিনিটের মধ্যেই এই যুদ্ধ ঘুরে যায় অন্যদিকে। সঙ্গী গোপাল সিংহ ফিরে গেছেন, ত্রিলোক সিংহের মৃত্যু হয়েছে, একাই অমৃত বিক্রমে সিংহের মতো লড়তে থাকেন যশোবন্ত সিং। তাঁর একার হাতে মৃত্যু হয় ৩০০ জন চিনা সেনার। না যশোবন্ত আর বীরবিক্রমে ফিরে আসতে পারেননি, ট্রেঞ্চে ফেরার আগেই মাথায় গুলি লাগে যশোবন্ত সিংয়ের। অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য মরণোত্তর মহাবীর চক্রে সম্মানীত হন যশোবন্ত সিং।

একটা বড় অংশের মানুষ বিশ্বাস করেন, একদিন নয়, টানা তিন দিন চলেছিল সেই যুদ্ধ। তিনটি ব্যাঙ্কার নিয়ে তিনি একাই লড়াই করেছিলেন। চিনা সৈন্যরা ভেবেছিলেন তিনটি বাঙ্কারের পেছনে প্রচুর ভারতীয় সেনা আছে। অনেকে আবার বলেন এখানকারই দুটি আদিবাসী মেয়ে সেলা ও নুরা যশোবন্তকে ভালোবাসতেন। যশোবন্ত বিবাহিত জানার পরও তাদের সেই ভালোবাসা এতটুকুও কমেনি। যুদ্ধের সেই মুহূর্তে ঐ দু’জন নারীও নাকি সাহায্য করেছিলেন। এমনকি শোনা যায় ওই দু’জন নারীও যশোবন্তের সঙ্গে মৃত্যুবরণ করেন।

তবে যেখানে এই যুদ্ধ হয়েছিল সেখানে তার সম্মান রক্ষার্থে তৈরি হয়েছে স্মৃতিসৌধ। সেই জায়গার নাম আজ হয়েছে যশোবন্তগড়। ভারতীয় সেনারা বিশ্বাস করেন চিনা আক্রমণের হাত থেকে আজও বাবা যশোবন্ত সিং তাদের রক্ষা করেন। তবে তার ইউনিফর্ম এখনো পরিষ্কার করে রাখা হয়। নিয়মিত পালিশ করা হয় তার বুটজোড়া। শোনা যায় মৃত্যুর পরও নাকি তিনি আজও ডিউটি করেন। প্রতিদিন সকালে তার ঘর অগোছালো হয়ে থাকে, আর তার বুটজোড়াতে লেগে থাকে কাদা। মৃত্যুর পরও তার প্রমোশন হয়েছে। রাইফেলমান থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উন্নীত হয়েছেন তিনি। আর মানুষের মনে উন্নীত হয়েছেন দেবতার পর্যায়ে। সেখানে আছে বাবা যশোবন্ত সিংয়ের মন্দিরও। ভারতীয় সেনারা সেখানে দিয়ে যাওয়ার সময় বাবা যশোবন্ত সিংয়ের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে যান।

এই ভাবেই ২১ বছরের একজন তরুণ ভারত মায়ের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেও সকলের মধ্যে বেঁচে আছেন। আজও অরুণাচল প্রদেশের বাসিন্দারা বাবা যশোবন্ত সিংয়ের নাম শুনলে শ্রদ্ধায় সম্মানে মাথা নিচু করেন।