মায়ের স্বপ্নপূরণ করতে চাকরি ছেড়ে মা’কে নিয়ে স্কুটারে ভারত ভ্রমণ যুবকের

নিজস্ব প্রতিবেদন : ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী’, এই কথাটা তো ছোটবেলা থেকে আমরা সকলেই শুনেছি। কিন্তু বাস্তবে মাকে স্বর্গের থেকেও বড় ক’জনইবা মনে করি। কজনই বা বাস্তব জীবনে মাকে সেই সম্মানটা দিই? সেই তো ঘরের এক কোণে পড়ে থাকেন বৃদ্ধা মা। আর গোটা বাড়ি শুদ্ধ মানুষ হইহুল্লোড় করে বেড়াতে চলে যান।

কিন্তু বাস্তবে এমন মানুষও আছেন মায়ের খুশি যাদের কাছে সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে যারা মোটা অঙ্কের চাকরিও ছেড়ে দিতে পারেন অবলীলায়। কৃষ্ণকুমার তেমনই একজন মানুষ। মায়ের ইচ্ছা, স্বপ্নপূরণের জন্য তিনি মোটা অঙ্কের চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে তাঁর বাবা মারা যান। এরপর মা’ই তাঁর একমাত্র অবলম্বন। কৃষ্ণকুমার ছিলেন একটি বড় কর্পোরেট সংস্থার টিম লিডার। সেই কাজ তিনি ছেড়ে দেন মায়ের ইচ্ছে পূরণের জন্য।

মা চূড়ারত্না দেবীর ইচ্ছে ছিলো তীর্থে তীর্থে ভ্রমণ করার। আর সেই ইচ্ছে পূরণের জন্যই ছেলে চাকরি ছেড়ে দেন। বাবা দক্ষিণামূর্তির উপহার দেওয়া স্কুটারে মাকে চাপিয়েই বিভিন্ন তীর্থক্ষেত্র ঘুরে বেড়াচ্ছেন দুজনে। ২ বছর আগে কর্ণাটকের মাইসুরু থেকে যাত্রাপথ শুরু করে এখন কৃষ্ণকুমার এসে পৌঁছেছেন বঙ্গে। ডুয়ার্সের বিভিন্ন মন্দিরগুলি ঘুরে দেখতে ব্যস্ত মা ও ছেলে। এরই মাঝে কৃষ্ণকুমার মুখোমুখি হন একটি সর্বভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের। বলতে শুরু করেন নিজের জীবনের কথা। দিনটা ছিলো ২০১৮ সালের ১৬ই জানুয়ারি যেদিন মাকে নিয়ে মাইসোরের বাড়ি থেকে ভ্রমণ শুরু করেন ছেলে। অনেক রাজ্য পেরিয়ে ২৪শে ফেব্রুয়ারি মালবাজার মহকুমার ওদলাবাড়িতে, বুয়া প্রসাদের বাড়িতে পৌঁছে যান তারা। আর গত ২৫ মাস ধরে স্কুটারে স‌ওয়ারি করেই ৫২০৩২ কিমি পথ অতিক্রম করেছেন কৃষ্ণ কুমার।

কত বয়স কৃষ্ণ কুমার বাবুর? তার এখন বয়স ৪১ বছর। আর তার মার সত্তরের কাছাকাছি।

কৃষ্ণকুমার বাবুর কথায়, “মা জীবনের বেশিরভাগ সময় রান্নাঘরেই কাটান। সকাল থেকে রাত অবধি বাড়ির কাজেই ব্যস্ত থাকতেন তিনি। সংসারের বাইরেও যে কিছু আছে তা দেখার ফুরসৎই মেলেনি তার। দর্শনীয় স্থান তো দূর, বাড়ির কাছেপিঠের মন্দিরগুলিও দেখে ওঠা হয়নি মায়ের।” অথচ এই মা’ই তো শৈশব থেকে আজ অবধি তার ইচ্ছের প্রতি সজাগ নজর রেখেছেন। তাই ছেলে হিসেবে নিজের দায়িত্ব কেই বা কী করে এড়িয়ে যেতেন কৃষ্ণকুমার? তাই মাকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লেন তিনি। কিন্তু এই ভাবনা তার মাথাতে কীভাবে এসেছিল? কৃষ্ণ কুমারের কথাতে, একদিন তিনি মাকে জিজ্ঞাসা করেন যে দেশের কোন কোন তীর্থক্ষেত্রগুলি তিনি যেতে চান। মা তাকে জানান, আশেপাশের মন্দিরগুলি দেখলেই যথেষ্ট। বড়সড় তীর্থ স্থান দেখার বয়স বা শক্তি কোনোটাই আর তার নেই। মায়ের এই আক্ষেপের কথা শুনেই ছেলের কষ্ট হতে থাকে। তাই একদিন মনস্থির করেই ফেললেন আর তারপর মাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন ভারত ভ্রমনে।

কিন্তু এত যানবাহন থাকতে স্কুটারে করে তীর্থভ্রমণ কেন? শারীরিক এত শ্রম জেনেও স্কুটার কেন? চাইলেই তো গাড়ি ভাড়া করতে পারতেন? বা যেতে পারতেন ট্রেনে বাসে? এর উত্তরে কৃষ্ণকুমার জানান, বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান তিনি। আর স্কুটারটি বাবার দেওয়া স্মৃতিচিহ্ন। তাই স্কুটার সাথে থাকলে তিনি তার পাশে বাবার উপস্থিতিও অনুভব করতে পারেন। তার এবং তার মা’র দুজনেরই মনে হয় এই স্কুটারটা সাথে থাকলেই তাদের পরিবার সম্পূর্ণ। তাই স্কুটার ছাড়া তীর্থ ভ্রমণ অসম্ভব তাদের কাছে।

কৃষ্ণ কুমার আরও বলেছেন যে, “বাবা মা’ই হলেন জীবন্ত ভগবান। আমার মনে হয় প্রতিটি সন্তানের উচিত অন্তত ৩০ মিনিট করে হলেও তাদের মা-বাবাকে সময় দেওয়া। বাবা-মা বেঁচে থাকতে, তাদের সেবা করাই আসল কাজ। তারা বেঁচে থাকতে তাদের জন্য কিছু না করে, তাদের মৃত্যুর পর ঘটা করে শ্রাদ্ধ করে হাজার লোক খাইয়ে সকাল বিকেল ছবিতে মালা দেওয়ার এই রীতি মোটেই সমর্থন যোগ্য নয়।” বাস্তবিক আজ যেখানে প্রায়শই খবরের কাগজ খুললেই বৃদ্ধ বাবা মায়ের প্রতি সন্তানদের নিষ্ঠুর আচরণের কথা চোখে পড়ে কৃষ্ণকুমারের মতো সন্তানরা সেখানে ব্যতিক্রম। এনাদের মত যোগ্য সন্তানদের থেকেই সন্তানদের কর্তব্য সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্মের শেখা উচিত।