সংক্রমণের ভয় থাকলেও রোজগার হারানোর ভয়ে কাজ চালাতে হচ্ছে পুরোহিতদের

সঙ্গীতা চৌধুরী : ২১ দিন আমাদের দেশ লকডাউন! হ্যাঁ লকডাউন! এই মুহূর্তে ঘরে থাকাটাই এখন একমাত্র সেভ। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার উভয়েই বলছেন বাড়িতে থাকুন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আবার বলেছেন, বাড়ির পরিচারিকা, ড্রাইভার, রাঁধুনিদের সবেতন ছুটি দিতে। লকডাউনের প্রকৃত অর্থ হলো এটাই।নিজেকে গৃহবন্দী করুন আর কোনো তৃতীয় ব্যক্তি যাতে আপনার গৃহে না আসে তাও নিশ্চিত করুন।

কিন্তু এই সকল গৃহ কার্যে সহায়িক ও সহায়িকাদের পাশাপাশি আরও একটি পেশা আছে, পৌরহিত্য। যে পেশায় একজন মানুষ প্রতিদিন অন্যের বাড়ি যান অন্যের বাড়ির বিগ্রহের পুজো করতে। হ্যাঁ, আমি নিত্য পুজার কথা বলছি। গ্রাম থেকে শহর সব জায়গায় এই নিত্য পুজো পদ্ধতি চালু আছে। যেখানে মানুষ তার প্রতিষ্ঠিত বিগ্রহের সেবার জন্য একজন পুরোহিতকে নিযুক্ত করেন এবং বহু মানুষ এই নিত্য পুজো করেই নিজেদের জীবনধারণ করেন। অনেকে বাড়ির মধ্যেই প্রতিষ্ঠা করেন মন্দির, রাখেন পুরোহিত।

এখন এই লকডাউনে যেখানে প্রাইভেট সেক্টরগুলিও কর্মচারীদের ছুটি দিয়েছেন সেখানে পুরোহিতরা আজও এই লকডাউনের মুহূর্তে পুজো করতে যাচ্ছেন বাড়ি বাড়ি। এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি। এইভাবে তো তিনিও সংক্রমিত হতে পারেন! আক্রান্ত হতে পারেন তিনিও! কিন্তু তিনি নিরুপায়! রুজি রোজগার বলতে এই পুজোই তার সম্বল! বর্তমান সময়ে পুরোহিতদের একটা অংশের বয়স ও পঞ্চাশ থেকে ষাট সত্তরের কোটায় (করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বেশী যে বয়সে)। কারণ বর্তমানে যুব সমাজের কেউ নতুন করে এই পৌরহিত্য পেশায় আগ্রহ দেখান না। ঠিক যেমন একজন চাষি তার ছেলেকে পড়ান অন্য পেশায় নিযুক্ত করতে ঠিক তেমনি একজন পুরোহিতও চান তার উত্তর প্রজন্ম অন্য কাজ করুক এই কাজ বাদে। হ্যাঁ, তার কারণ এই পেশাতে কোনোরকম ছুটিই নেই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনৈক পুরোহিতের বক্তব্য, “যজমানদের ফোন করলে লকডাউনের কথা বলতেই তারা পরিস্কার জানাচ্ছেন, না এলে মাইনে কাটা যাবে!অনেক যজমান আবার ছুটি দিতেও চাইছেন না! পরিস্কার বলে দিচ্ছেন করোনা হবার হলে এমনিই হবে! ঘরে বসে থাকলেও করোনা হতে পারে! একবেলা একটু গিয়ে পুজোটা করে আসবেন! তাতেই করোনা হয়ে যাবে!” তাই দ্বিধায় দ্বন্দ্বে পড়েছেন পুজারী! কেউ ভাবছেন পুজো ছেড়ে দেবেন আর কেউ ভাবছেন কষ্ট করে হলেও না হয় যাবেন!

এই বিশ্ব মহামারীর সময় আমরা কি পারি না একটু মানবিক হতে? এই তিন সপ্তাহ যদি নিজের বাড়ির পুজো নিজেই করি তাতেই ইষ্টদেব সন্তুষ্ট হবেন। কারণ জীবের সেবাই তো ঈশ্বরের সেবা। আর একজন বয়স্ক মানুষ যিনি আপনার সহ আরও একাধিক জনের বাড়ি আসবেন পুজো করতে তার থেকেও কী সংক্রমণের ভয় থেকে যাচ্ছেনা! পরিচারিকা, ড্রাইভারদের সাথে এই সকল পূজারীদেরও ছুটি দিন। মন্দির হলে মন্দির লাগোয়া কোনো ঘরে তার থাকার ব্যবস্থা করুন। কিন্তু একটু ভেবে দেখুন এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি এক রাস্তা থেকে অন্য রাস্তা, এত খানি যাত্রা পথে কী সংক্রমণের ভয় থাকছে না! আপনার স্বার্থপরতা সংকীর্ণতার জন্য আপনারই এলাকায় মহামারী ঘটে যেতে পারে যে কোনো মুহূর্তে! তাই এবার একটু অন্যদের কথা ভাবুন। ভাবুন গরীব রিক্সাওয়ালার কথা, ভাবুন পথশিশুদের কথা, ভাবুন রাস্তার কুকুরদের কথা! কারণ আপনি একা বাঁচতে পারবেন না। আপনার পাড়া সংক্রমিত হলেও আপনার কিছুই হবে না, এমন ভাবনা আজই ছাড়ুন। সচেতন হোন। সচেতনতা ছড়ান‌।

সম্প্রতি সোশ্যাল সাইটেও কিছু তরুণ তরুণীরা গরীব রিক্সাওয়ালা, পথের কুকুর, খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য সরব হ‌ওয়ার পাশাপাশি পূজারীদের সংকট নিয়েও একটি পোষ্ট করেন। তাদের পোষ্টগুলির বক্তব্য ছিলো, “যারা পুজো করেন তারাও মানুষ।” কেউ এই মূল পোষ্টটিকেই শেয়ার করে লিখেছেন, “প্লিজ কেউ লকডাউনের এই মুহূর্তে কোনো পূজারীকে এমন আবেদন (পুজো করতে আসার জন্য জোর) করবেন না।” আবার কেউ লিখেছেন, “এ কদিন নিজের মতো করে নিজের বাড়ির পুজো নিজে করলে ভগবান খুব বেশি অসন্তুষ্ট হবেন বলে মনে হয় না।” আর এমন ঘটনা এখনো ঘটে চলেছে মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, নদীয়া ইত্যাদি আমাদের রাজ্যের বিভিন্ন জেলায়।

তাই আবারও বলছি ‘Stay Home’, এটাই এখন নিজেকে নিরাপদ রাখার একমাত্র রাস্তা। শুধু আমরা বলছি না, বলছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী, বলছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, বলছেন সেলিব্রেটিরা, বলছেন বিশেষজ্ঞরা, বলছেন বিজ্ঞানীরা।