করে দেখালো ভারত, প্রথমবার করোনা ভাইরাসের জিনের গঠন চিহ্নিত হলো ল্যাবে

নিজস্ব প্রতিবেদন : ভারতে করোনা সংক্রামিতের সংখ্যা দিন দিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এখন অব্দি করোনাতে ভারতবর্ষে ১৩৩৮৭ জন সংক্রামিত, পশ্চিমবঙ্গে ২৫৫ জন। করোনা সংক্রমণ রুখতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পুরো দেশেই জারি করেছেন লকডাউন। আগে লকডাউনের সময়সীমা ছিল ১৪ই এপ্রিল। সম্প্রতি তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৩ রা মে অবধি। নিজের ও পরিবারের কথা ভেবে দয়া করে লকডাউনকে মেনে চলুন‌।

এখন এই যে করোনাভাইরাস গোটা দেশ তথা বিশ্ববাসীকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে এই করোনাভাইরাসের জিনের গঠনটি কীরকম হতে পারে তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা চলছিল। গবেষকরা প্রথমদিকে সিঙ্গল স্ট্র্যান্ডেড এই RNA ভাইরাসের ৭ টি স্ট্রেন থাকার ব্যাপারে বললেও এই ভাইরাসের জিনোমের পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ সম্পর্কে আলোকপাত করতে পারেননি। এই বিষয়টি নিয়ে তখন গবেষণা চলছিল। সমস্ত বিজ্ঞানীমহল যখন ধোঁয়াশার মধ্যে রয়েছেন তখন ভারতের বৈজ্ঞানিকরা সফলতার এক ধাপ এগিয়ে গেলেন। সার্স-কভ-২ এর পূর্ণাঙ্গ জিনোমের বিশ্লেষণ করছেন একদল ভারতীয় বিজ্ঞানী। এই সফলতা আমাদের ভারতের গর্ব। ভারতের গুজরাটের বিজ্ঞানীরা এই বিষয়ে আলোকপাত করেছেন।

GBRC অর্থাৎ গুজরাট বায়োটেকনোলজি রিসার্চ সেন্টারের বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে নতুন এই করোনাভাইরাস জিনের গঠন নিয়ে গবেষণা করছিলেন‌। এর ফলে সেখানকার বিজ্ঞানীরা এই নয়া করোনাভাইরাসের ভাইরাসের জিনোম সিকুয়েন্সিং করতে সক্ষম হয়েছেন। এই বিষয়ে GBRS র বিজ্ঞানীদের বক্তব্য “এই ভাইরাসের মধ্যে এমন একটি ক্ষমতা আছে যার জন্য সে বহুবার নিজের মিউটেশন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে।বারংবার মিউটেশন হওয়ার ফলে ভাইরাসটি নিজের জিনের গঠন বদল করে ফেলেছিল। জিনের গঠন বারবার বদলে যাওয়ার ফলে সার্স কভ ২ এর জিনোম সিকোয়েন্স করা মোটেই সহজ ছিল না। বিষয়টি বেশ জটিল ছিল। যদিও এই ভাইরাসটি বিটা করোনাভাইরাসের পরিবারের সদস্য তবু এই দুটি ভাইরাস অনেকখানি আলাদা।বিটা করোনা ভাইরাসের সাথে সার্স কভ ২ ভাইরাসের জিনের একটি মিল থাকলেও বারংবার মিউটেশনের ফলে সার্স কভ ২ এর জিনের পূর্ণাঙ্গ গঠন বের করাটা ভীষণ রকম চ্যালেঞ্জিং ছিল।”

সেখানকার বিজ্ঞানীরা আরও বলেছেন, “এই মারণ ভাইরাসের জিনোম বিশ্লেষণ করতে আমরা সক্ষম হয়েছি। এই ভাইরাসের জিনের গঠন সম্পূর্ণ ভাবে জানার ফলে এইবার ভাইরাসটির চরিত্র ভালোমত বোঝা যাবে। এরফলে এই ভাইরাস কীভাবে মানুষের শরীরে সংক্রমণ করে ও কীভাবে তা এক মানুষ থেকে অপর মানুষের মধ্যে সংক্রামিত হচ্ছে সেটিও বোঝা যাবে এবং তার ফলে খুব শীঘ্রই এই ভাইরাসের প্রতিরোধক আবিষ্কার করা সম্ভবপর হবে।”

করোনা ভাইরাস আসলে নতুন কোন ভাইরাস নয়। এটি আগেও ছিল। এই ভাইরাসের পরিবারের সদস্য অনেক বেশি। এই ভাইরাসের পরিবারকে বিজ্ঞানের ভাষায় ‘করোনাভিরিডি’ (Coronaviridae) বলা হয়। এই ভাইরাস পরিবারের চারটি ভাগ আছে। যথা- ১) আলফাকরোনাভাইরাস (alphaCoV), ২) বিটাকরোনাভাইরাস (betaCoV), ৩) ডেল্টাকরোনাভাইরাস (deltaCoV) ও ৪) গামাকরোনাভাইরাস (gammaCoV)।

আলফাকরোনা ও বিটাকরোনার জিন বাদুর ও ইঁদুরের মধ্যে অনেক আগেই পাওয়া গেছে। এছাড়া বিটা করোনার জিন প্যাঙ্গোলিনের মধ্যেও পাওয়া গেছে। শুধু বাদুড় বা ইঁদুর নয় এছাড়াও উট, গবাদি পশুদের মধ্যেও অনেক সময় এই ভাইরাস পরিবারের অনেক সদস্যদের খোঁজ পাওয়া গেছে। গামাকরোনা ও ডেল্টাকরোনা ভাইরাস হয় পাখিদের। এই ভাইরাসের চারটি পরিবারের মধ্যে বিটাকরোনা ভাইরাসকে সবথেকে ক্ষতিকারক বলে উল্লেখ করেছেন বিজ্ঞানী মহল। কারণ এই বিটা ভাইরাসকে আবার পাঁচটি সাব-জেনাসে ভাগ করা হয়েছে। এদের সবকটি স্ট্রেনই হলো লাগামছাড়া। এই ভাইরাসগুলো সবকটি মানুষকে সংক্রামিত করে তবে এই ভাইরাসের স্ট্রেনগুলির মধ্যেও পার্থক্য আছে। কোনোটি জ্বর সর্দির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে আবার কোনোটি ভয়াবহ মহামারী আকার ধারণ করে। মানুষের শরীরে সংক্রমণ করে থাকে আলফা ও বিটা করোণা, তাই এই করোনা দুটি ক্ষতিকারক এবং এদেরকে হিউম্যান করোনাভাইরাস বলা হয়। কিন্তু এই দুটি ভাইরাসের মধ্যে আবার বিটা করোনা সব থেকে বেশি ক্ষতিকারক। কারণ আজ পর্যন্ত যতবারই মহামারী হয়েছে তার পিছনে রয়েছে এই বিটা করোনাভাইরাসের অবদান। হিউম্যান ভাইরাস দুই রকম, একটি ক্ষেত্রে সাধারণ উপসর্গ দেখা যায়।অন্য ক্ষেত্রে মহামারী হয়। সাধারণ হিউম্যান করোনা হলো HCoV-OC43 ও HCoV-HKU1। এরাও বিটা করোনারই বংশধর। আরও দুটি সাধারণ হিউম্যান করোনাভাইরাস হলো  HCoV-229E ও  HCoV-NL63। এরা হলো আলফাকরোনার বংশধর। এই ভাইরাস সংক্রমণে সর্দি, জ্বর, শ্বাস কষ্ট দেখা দেয়। যাদের ইমিউনিটি পাওয়ার কম অর্থাৎ বয়স্ক ব্যক্তিরাই মূলত সংক্রামিত হন এই ভাইরাসে।

বিটাকরোনা পরিবারের যে এই সদস্যদের ফলে মহামারী হয়েছে এবার তাদের কথা বলি

১) করোনাভাইরাস (সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটারি সিন্ড্রোম SARS-CoV)।

২) মার্স-করোনাভাইরাস (মিডল ইস্ট রেসপিরেটারি সিন্ড্রোম MERS-CoV)

৩) সার্স-সিওভি-২ (SARS-COV-2)।

বিটা করোনার বংশধরদের ফলেই ২০০২-২০০৩ সালে সার্স মহামারী হয়েছিল। ২০১২ সালে আরবে, ২০১৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়াতে, ২০১৮ সালে সৌদি আরব আর আরও কয়েকটি দেশে মহামারী রূপ নিয়েছিলো মার্স ভাইরাস। এখন বিটা ভাইরাসেরই পরিবারের অপর সদস্য সার্স-কভ-২ পুরো বিশ্বে মহামারী রূপ ধারণ করেছে।