নিজস্ব প্রতিবেদন : ‘তন্ত্রসার’ গ্রন্থের রচয়িতা কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের প্রপৌত্র সার্বভৌম আগমবাগীশ আজ থেকে চারশো বছর আগে শান্তিপুরে আগমেশ্বরী মায়ের পুজো শুরু করেন। সিদ্ধিলাভের পর দেবী আগমেশ্বরী মায়ের আদেশ পেয়েই তিনি গঙ্গার মাটি দিয়ে মাতৃপ্রতিমা নির্মাণ করেন। এরপর সেই প্রতিমার বিধিসম্মত ভাবে পুজো করে তাকে নিজে হাতে বিসর্জন দেন। সেই প্রথমবার সার্বভৌম আগমবাগীশের হাতে মায়ের পুজোর সূচনা। দেবী আগমেশ্বরীর পুজোয় আজও এই প্রাচীন রীতি অনুসৃত হয়ে আসছে। তবে বিসর্জনের নিয়মটাই একটু পার্থক্য ঘটেছে। একটা সময় বিসর্জনের জন্য মাকে কাঁধে করে নিয়ে যাওয়া হতো শান্তিপুর মতিগঞ্জের ঘাটে। বর্তমানে মাকে বিসর্জনের সময় ট্রলারে করে নিয়ে যাওয়া হয়।
শান্তিপুরের অদ্বৈতাচার্যের পৌত্র মথুরেশ গোস্বামীর মেয়েকে বিয়ে করার পর শ্বশুর মহাশয়ের অনুরোধে নবদ্বীপের সার্বভৌম আগমবাগীশ শান্তিপুরে আসেন। মথুরেশ গোস্বামীও তন্ত্রসাধক জামাইয়ের তন্ত্রসাধনার জন্য নিজের বাড়ির কাছেই একটি পঞ্চমুন্ডির আসন স্থাপন করেন। আর এই পঞ্চমুন্ডির আসনেই সাধনা করে সার্বভৌম সিদ্ধিলাভ করেন। পরবর্তীতে এই পঞ্চমুন্ডির আসনই ‘আগমেশ্বরীতলা’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
এই আগমেশ্বরী মায়ের মূর্তি বিশাল উচ্চতা সম্পন্ন হয়। প্রায় ১৬-১৮ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন আগমেশ্বরী মায়ের পুজো আজও প্রাচীন রীতি নীতি মেনে ঐতিহ্যের সঙ্গে ধুমধাম করে পালিত হয়। অন্যান্য কালী পুজোর ক্ষেত্রে যেখানে পশু বলিদান হয়, সেখানে আগমেশ্বরী মা পূজিতা হন সাত্ত্বিকভাবে। বৈষ্ণব ধর্মালম্বীদের মত রক্তে পুজো এখানে নিষিদ্ধ। মায়ের পুজোয় তাই এখানে আঁখ, চাল কুমড়ো ইত্যাদি বলিদান করা হয়।
আগমেশ্বরী মায়ের পুজোর বিশেষ আকর্ষণ হলো এখানে ৩৬ রকমের ব্যঞ্জনের নিবেদিত সকল ভোগই হয় নিরামিষ। গোস্বামী বাড়ির দীক্ষিত মহিলারা সম্পূর্ণ নিষ্ঠার সঙ্গে মায়ের ভোগ প্রস্তুত করেন। বর্তমানে মায়ের পৌরহিত্যে নিযুক্ত আছেন রঘুনাথ ভট্টাচার্য। এর আগে রঘুনাথ বাবুর পূর্বপুরুষরাই মায়ের পুজোয় নিযুক্ত ছিলেন।
শান্তিপুরের আগমেশ্বরী পুজোর সমস্ত দায়িত্ব পালন করেন বড় গোস্বামী পরিবারের সদস্যরা। দুর্গা পুজোর বিজয়া দশমীর দিন মা আগমেশ্বরীর পাটে সিঁদুর দিয়ে পুজো করা হয়। এরপর কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর দিন ‘পাটখিলান’ বলে একটি অনুষ্ঠান পালিত হয়। প্রাচীন রীতি মেনেই এই অনুষ্ঠান পালিত হয়। এরপর মায়ের মৃন্ময়ী রূপ তৈরি হয়। কালীপুজোর দিন মায়ের রং করা হয়। এই দিন রাত ন’টা নাগাদ বাড়ির সদস্যরা মাকে গহনা পরান। আর তারপর রাত্রে হয় মায়ের চক্ষুদান পর্ব। যে মৃৎশিল্পী মায়ের চক্ষুদান করেন তিনি সারা দিন উপবাস রেখে শুদ্ধ বস্ত্র পরিধান করে মায়ের চক্ষু দান করেন।
চক্ষুদানের পর্ব মিটে গেলে বড় গোস্বামী পরিবারের সম্পাদক মাকে সিঁদুর দান করেন। এরপর একে একে গন্ধ দান, আতর দান ইত্যাদি করে মায়ের পুজো শুরু হয় রাত্রি এগারোটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে। সারারাত ধরে আগমেশ্বরী মায়ের পুজো হয়। ভোরের দিকে মায়ের পুজো শেষ হয়।
মায়ের ভোগের ক্ষেত্রে এলাহি রকমের ব্যবস্থা করা হয়। শুধু মায়ের জন্য প্রস্তুত করা ভোগে থাকে – তিন রকমের শাক, বিভিন্ন ধরনের ডাল, চাল কুমড়োর তরকারি, মিষ্টি কুমড়ো তরকারি, শুক্তনি, কচুর দম, বাঁধাকপির তরকারি, ছানার ডালনা, এঁচোড়ের তরকারি, পোলাও, চালতার চাটনি, টমেটোর চাটনি, নানা রকমের মিষ্টান্ন। মরশুমি যত ধরনের ফল পাওয়া যায় সমস্ত ফল ও নিবেদন করা হয় মাকে। আগমেশ্বরী কালী মায়ের এই ভোগের পাশাপাশি পূজার পরের দিন ভক্তদের জন্য আলাদা ভোগ নিবেদন করা হয় এবং এর জন্য আলাদা ভাবে আয়োজন ও করা হয়। সেই আয়োজনও কিছু কম নয়। নবদ্বীপের গোস্বামী আশ্রমের প্রতিনিধিরা এই ভোগের রান্না করতে আসেন। আর এই ভাবেই প্রতিবছর মহাসমারোহে শান্তিপুরে আগমেশ্বরী মায়ের পুজো হয়। পুজোর দিন প্রচুর ভক্তের সমাগম ঘটে মন্দির প্রাঙ্গণে।
তবে এই বছর করোনার আবহের কারণে মায়ের পুজো একটু ভিন্ন রকম ভাবে হবে। অন্যবার যেমন ভক্তবৃন্দের জন্য আলাদা করে প্রসাদের আয়োজন করা হয় এইবার তেমনটা হবে না। মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত ভোগটুকুই কেবল মাকে নিবেদন করা হবে। এর পাশাপাশি করোনার কারণে এই বছর মায়ের গর্ভগৃহে বাইরের কেউ প্রবেশাধিকার পাবে না। এমনকি সংঘবদ্ধভাবে মানুষকেও মন্দিরের মধ্যে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে অল্প সংখ্যক মানুষ মাকে এসে দর্শন করে যেতে পারবেন।