নিজস্ব প্রতিবেদন : স্বাধীনতা দিবসের দিনটিকে প্রতিবছর আমরা বেশ আড়ম্বরের সাথেই পালন করে থাকি। লালকেল্লা থেকে শুরু করে অজ পাড়া গ্রাম, ছোট থেকে বড় নানান অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়ে থাকে। আর সেই অনুষ্ঠানে স্মরণ করা হয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের। কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখেছেন, যে এই বিপ্লবীদের মধ্যে নারীদের ভূমিকা ঠিক কতটা? নারীদের মধ্যেও বাঙালি নারীদের ভূমিকা কতটা!
আমরা ভুলে গেছি সেই মহান বাঙালি নারীদের আত্ম বিসর্জনের কথা যারা তাঁদের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন দেশের জন্য। এমনই বেশ কয়েকজন বাঙালি নারীর স্বাধীনতা সংগ্রামী রয়েছেন যাদের আমরা অনেকে হয় তো জানিই না। আবার যারা জানি তারাও হয়তো ভুলতে বসেছি, তাদের হারিয়ে ফেলছি ইতিহাসের পাতায়।
ইতিহাস বলছে ইংরেজ সাম্রাজ্যের শুরু থেকেই বাংলার মানুষ বাঙালিরা ভারতকে স্বাধীন করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। বাঙালি বিপ্লবীরাই হয়ে উঠেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান মুখ, বাকিদের উৎসাহদাতা।
সেই সময় যখন গোটা ভারতবর্ষ ইংরেজ শাসনে পরাধীন তখন বাংলার নারীরা পরাধীন ছিলেন নিজের নিজের বাড়িতেই। বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ ও সতীদাহের মত বর্বর প্রথাগুলি পায়ে বেড়ি পরিয়ে রেখে ছিল বাঙালি নারীদের। কিন্তু তাসত্ত্বেও সবকিছুকে উপেক্ষা করে তারাই দলে দলে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন।
বীণা দাস : ১৯১১ সালের ২৪শে আগস্ট কৃষ্ণনগরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বাংলার এক স্বাধীনতা সংগ্রামী নারী বীণা দাস। তাঁর পিতা ছিলেন বেণীমাধব দাস। যিনি একজন বিশিষ্ট সমাজসেবী ও ছাত্র দরদী বিদ্যান শিক্ষক ছিলেন। আর বীণা দেবীর মা সরলা দেবী নিঃস্ব ও অসহায় মহিলাদের সাহায্যার্থে তৈরি করেছিলেন সরলা পুণাশ্রম।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর লেখা বই ‘ভারত পথিক’ থেকে জানা যায়, র্যাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলে পড়াকালীন তিনি বেণীমাধব দাসের ছাত্র ছিলেন। তখন থেকেই সুভাষের মনে দেশপ্রেমের অমোচনীয় দাগ কেটে গেছেন তিনি।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশন হলে ১৯৩২ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বাংলার গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনের উপর গুলি চালিয়ে গ্ৰেপ্তার হয়েছিলেন বীণা। পরবর্তী কালে বীণা দেবী যোগ দিয়েছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে।
ননিবালা দেবী : ননিবালা দেবী জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৮৮ সালে হাওড়ার বালিতে। খুব অল্প বয়সেই তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। তবে তিনি মাত্র ১৬ বছর বয়সে বিধবা হন এবং বাবার কাছে চলে আসেন। এরপর ধীরে ধীরে তিনি ঝুঁকতে থাকেন স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে।
১৯১৫ সালে ননিবালা দেবী অমরেন্দ্র চ্যাটার্জীর কাছে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপ্লবী হওয়ার দিক্ষা নেন। তাঁর অবদান ছিল বিপ্লবীদের রিষড়া ও চন্দননগরে ভাড়াবাড়িতে আশ্রয় দিয়ে রাখা। এছাড়াও রামচন্দ্র বাবুর স্ত্রী সেজে জেলে গিয়ে পিস্তলের খোঁজ নিয়ে আসা ছিল তাঁর আর একটি উল্লেখযোগ্য কাজ। তিনি ১৯১৯ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দী ছিলেন। তাঁর শেষ জীবন খুব অবহেলার সাথে কেটেছিল। তাঁর শেষ জীবনে তাঁকে পুলিশের ভয়ে কেউ আশ্রয় দিতে চান নি। কষ্ট ও দরিদ্রতা ছিল তাঁর জীবনের নিত্য সঙ্গী।
তিনি সরকারের কাছে সাহায্য বলতে পেয়েছিলেন যতটুকু তা হলো পঞ্চাশের দশকে পঞ্চাশ টাকা করে পেনশন। ননিবালা দেবী ছিলেন বাংলার প্রথম মহিলা স্টেট প্রিজনার। ১৯৬২ থেকে ১৯৬৭ সালের মধ্যে কোন এক সময়ে তিনি ইহলোক ত্যাগ করে পরলোকে গমন করেন। তাঁর মৃত্যুর সঠিক তথ্য এখনও জানা যায়নি।
আভা দে : দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আভা দে কোনো পুরুষের থেকে কম ছিলেন না। তিনি তাঁর সাহস ও শারীরিক শক্তির জোরে জীবনকে তুচ্ছ করে দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সাঁতার কাটা থেকে শুরু করে দৌঁড়ানো, গাছে ওঠা, সাইকেল চালানো সবেতেই ছিলেন পারদর্শী তিনি। আভা দে তাঁর বন্ধু কল্যাণী দাসের সঙ্গে ‘ছাত্রীসংঘ’তে যোগদান করেছিলেন। সেসময় একবার ছাত্রীসংঘ থেকে সাইকেল প্রতিযোগীতার আয়োজন করা হয়। সেখানে তিনি নাম দিয়ে কলকাতা থেকে বর্ধমান পর্যন্ত প্রায় ১০০ কিমিরও বেশি পথ সাইকেল চালিয়ে প্রথম হন।
এই স্বাধীনতা সংগ্রামীর এমনও অনেক দিন অতিবাহিত হয়েছে যখন তিনি দু চার পয়সায় তেলে ভাজা খেয়েই গোটা দিন কাটিয়ে দিয়েছেন। তিনি চরম সাহসী একজন মহিলা ছিলেন। তাঁর সাহসিকতার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর প্রতিরোধেই। তিনি এমন একজন নারী যিনি ইংরেজ পুলিশের ঘোড়ার লাগাম টেনে প্রতিরোধ জানিয়ে ছিলেন।
আভা দে ১৯৩০ সালে নারী সত্যাগ্রহ সমিতির সঙ্গে যুক্ত হন। এরপর তিনি বেআইনি শোভাযাত্রা ও সভায় যোগদান করার অপরাধে গ্রেপ্তার হন এবং প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দী থাকেন। আভা দে এমন একজন বাঙালি নারী স্বাধীনতা সংগ্রামী যাঁর জন্মকাল, জন্মস্থান সম্পর্কে কিছুই তেমন জানা যায় নি। তবে তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে জানা গিয়েছে সম্ভবত তিনি ১৯৩৮ সালে দেওঘরে বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।