নিজস্ব প্রতিবেদন : দেশ যখন স্বাধীনতা দিবসের আনন্দ উদযাপিত করছিল সেসময় ১৫ই আগস্টের পরিবর্তে মুর্শিদাবাদের একটা অংশে ভারতীয় পতাকা উত্তোলন হয় ১৭ই আগস্ট মধ্যরাতে। আর মূলে যা রয়েছে তার ইতিহাস এখনও প্রবীণদের মুখে শোনা যায়। জানা যায় ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন ১২ই আগস্ট ১৯৪৭ ঘোষণা করেন ১৫ই অগাস্ট থেকে ভারত স্বাধীন হবে। কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি হয় বাংলাকে নিয়ে। কারণ দেশভাগ-পরবর্তী মানচিত্র তৈরি করার দায়িত্বে থাকা সিরিল র্যাডক্লিফ, সম্পূর্ণ মুর্শিদাবাদকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করে দিয়ে দিয়েছিলেন।
আর যে কারণে ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট যখন সারা দেশ স্বাধীনতার আনন্দে মেতে উঠেছিল সেই সময় ১৫ থেকে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত তিনদিনের জন্য পশ্চিমবঙ্গের এই মুর্শিদাবাদ জেলা সেই সময় স্যার সিরিল র্যাডক্লিফের নেতৃত্বে বাউন্ডারি কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) অন্তর্ভুক্ত ছিল। সিরিল র্যাডক্লিফের বাউন্ডারি লাইনের কলমের খোঁচায় শুধু মুর্শিদাবাদ নয়, পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে চলে যায় মালদা, নদীয়া, পশ্চিম দিনাজপুর, ২৪ পরগনা এই সকল জেলারও একাধিক অংশ। মুসলিম সম্প্রদায় অধ্যুষিত এলাকার জন্যই এই জেলা পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে যায়।
মুর্শিদাবাদ জেলার তৎকালীন সদর শহর বহরমপুরের ব্যারাকস্কয়ার মাঠে ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট সবুজ রঙের পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। পতাকা উত্তোলন করেন তৎকালীন মুর্শিদাবাদের জেলাশাসক আই.সি.এস অফিসার আই.আর.খান। মঞ্চে সেই সময় উপস্থিত ছিলেন মুসলিম লীগের নেতারা। সেখানে উপস্থিত ছিলেন কাজেম আলী মির্জা, বামনেতা সনত্ রাহ, আরএসপি’র নিতাই গুপ্ত এবং অন্যদিকে কংগ্রেসের শ্যামাপদ ভট্টাচার্য।
আর তখনই মুর্শিদাবাদের নবাব ওয়াসেফ আলি মির্জা দাবি তোলেন মুর্শিদাবাদকে ভারতভুক্ত রাখতে হবে। তবে দাবি উঠলেও কংগ্রেস ও মুসলিম নেতৃত্বের আলোচনায় কোনো সুরাহা হয় নি। পাকিস্তানপন্থী মুসলিম লীগ নেতারা মুর্শিদাবাদের মতো ঐতিহাসিক জেলাকে ছেড়ে দিতে রাজি হন নি।
অবশেষে বিনিময় পদ্ধতির জন্য আলোচনা হয়। মুর্শিদাবাদ জেলাকে ভারতভুক্ত করার বিনিময়ে ভারতকে ছাড়তে হয় খুলনা জেলা। সিদ্ধান্ত হয় দুই দেশের বর্ডার যত বেশি নদী বরাবর হবে ততই সাসনকার্যে ও সীমানা নির্ধারণে সুবিধা হবে। এই যুক্তি অনুযায়ী একদিকে গঙ্গা আর অন্যদিকে পদ্মা নদীকে সীমান্ত করে দেশভাগ করে মুর্শিদাবাদ জেলাকে ভারতভুক্ত করা হয় ১৯৪৭ সালের ১৭ই আগস্ট মধ্যরাতে। আর তারপরেই ১৮ই আগস্ট সকালে মুর্শিদাবাদ জেলায় উত্তোলন করা হয় ভারতের তেরঙ্গা জাতীয় পতাকা।
তৎকালীন মুর্শিদাবাদের জেলাশাসক আই.এ. খান ১৯৪৭ সালের ১৭ই আগস্ট পদত্যাগ করে মুর্শিদাবাদ ছেড়ে চলে যান। তবে শুধু জেলাশাসক আই.এ. খানই নন, একই রকম ভাবে এলাকার অনেক মানুষই আতঙ্কিত হয়ে মুর্শিদাবাদ ছেড়ে ততকালিন পুর্ব পাকিস্তানের দিকের রওনা দিয়েছিলেন। সেই দিনের ঘটনা মনে করতে গিয়ে হরিহরপাড়ার চুয়া এলাকার প্রৌঢ় নিয়ামত আলী হোসেন জানিয়েছিলেন, সেই সময় শুধুমাত্র প্রধান সরকারি দফতর ছাড়াও অনেক মানুষের বাড়ির ছাদে, কেশরী বালিকা বিদ্যালয়ের ছাদে এবং আরও নন জায়গায় তিরঙ্গা নয় বরং উত্তোলন করা হয়েছিল পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা।
তিনি আরও জানান, “সেই সময় জেলায় সবার মধ্যেই একটা অদ্ভুত রকমের ভয় কাজ করছিল। কেউ বাড়ির বাইরে বেরোচ্ছিলেন না। ১৪ই আগস্ট ১৯৪৭ জেলায় খবর ছড়িয়ে পরে তাদের পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তৈরি হতে শুরু করেছিল পাকিস্তানের পতাকা। ১৫ই আগস্ট ১৯৪৭ বিভিন্ন জায়গায় সবুজ পতাকা হাতে মিছিল বেরিয়েছিল। স্লোগান উঠছিল চারিদিকে ‘হাতে বিড়ি, মুখে পান, লাঠির আগায় পাকিস্তান’।”
নবাব সৈয়দ রেজা আলী মির্জা বর্তমানে ছোট নবাব বলে পরিচিত ছিলেন। তিনি জানান, “সময়টি সবার জন্যই ছিল খুব কঠিন। নবাবের পূর্বপুরুষরা সর্ব ধর্মের প্রতি ভাতৃত্বে বিশ্বাসী থাকায় তারা মুর্শিদাবাদকে ভারতের সাথে যুক্ত করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন। এর ফলস্বরূপ তিন দিন পর, অর্থাৎ ১৭ই আগস্ট ভারতের সাথে যুক্ত হয় মুর্শিদাবাদ।” তিনি জানান, “পরবর্তীকালে মুর্শিদাবাদের লালবাগ শহরেই ওয়াসেফ আলী মির্জার সহযোগিতায় ‘হিন্দু মুসলিম কনফারেন্স’ নামের বিশেষ সভা আয়োজন করে সমগ্র জেলায় সব ধর্মের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বার্তা দেওয়া হয়।”
একইভাবে সেই সময় দিল্লিতে কংগ্রেস নেতা শশাঙ্কশেখর সান্যাল, জনসংঘের শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় চেষ্টা করছিলেন কত তাড়াতাড়ি মুর্শিদাবাদকে ভারতের সাথে যুক্ত করা যায়। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলির যুক্তি ছিল গঙ্গা নদীকে ধরে ভৌগলিক সীমারেখা হিসেবে বিবেচনা করে পুনরায় সীমারেখা সংশোধন করা। আর তারপর তিনদিন ধরে নানান যুক্তি তর্কের পর অবশেষে ১৭ই আগস্ট ভারতের সাথে যুক্ত হয় মুর্শিদাবাদ।
এরপর ১৮ই আগস্ট ব্যারাক স্কোয়ার মাঠে জেলাশাসক আই.আর.খান তিরঙ্গা উত্তোলন করে দেন। যেমনভাবে ১৫ই আগস্ট পাকিস্তানের সবুজ পতাকা উঠেছিল। ১৮ তারিখ ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন হতেই সুধীন সেন গেয়ে ওঠেন, “সোনার দেশে গড়বো মোরা সোনার হিন্দুস্তান, সুখ, শান্তি আনবো মিলে হিন্দু মুসলমান।”