নিজস্ব প্রতিবেদন : লাদাখের গালওয়ান উপত্যকার দখল নিয়ে চীন ও ভারতীয় সেনার রক্তাত্ব সংঘাতে ২০ জন ভারতীয় সেনার মৃত্যু দুই দেশের মধ্যে প্রত্যক্ষ যুদ্ধের সম্ভবনা তৈরি করেছে। যদিও বেশ কয়েকবছর ধরে ভারত ও চীনের ৩ হাজার ৪৪০ কিলোমিটার যে সীমান্ত রেখা তা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে কূটনৈতিক সংঘাত চলছিল। ২০১৬ সালে সিকিমের ডোকলাম অঞ্চলে কূটনৈতিক সংঘাত চরম আকার নেয়। প্রশ্ন উঠছে ১৯৬২ যুদ্ধের পর দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে ভারতীয় সীমান্ত এলাকায় চীন চুপচাপ থাকলেও বর্তমানে এত আগ্ৰাসনের ভূমিকা নিচ্ছে কেন? উঠে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
দেখা যাচ্ছে, বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক বাজার দখলের লড়াইয়ে আমেরিকার সঙ্গে চীনের দ্বিতীয় শীত যুদ্ধ শুরু হয়েছে। তিনটি বিষয় নিয়ে এই লড়াইয়ের সূত্রপাত। ১. বাণিজ্য, ২. তথ্য, ৩. জিওপলিটিক্যাল অ্যাডভান্টেজ। ডোনাল্ড ট্রাম্প, আমেরিকা ও চিনের মধ্যে বাণিজ্য সমঝোতা আলোচনা চলাকালীনই ২০ হাজার কোটি ডলার মূল্যমানের চীনা পণ্যের শুল্কের পরিমাণ ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করার ঘোষণা করেছেন। চীনা পণ্য এবার আমেরিকায় প্রবেশ করতে গেলে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক পরিশোধ করতে হবে। আমেরিকার কোন প্রশাসন এমনভাবে এর আগে চীনের পণ্যের বিরুদ্ধে শুল্ক বসায় নি।
বেজিং এর প্রতিশোধ নিতে আমেরিকা পণ্যের উপর শুল্ক বসিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে মার্কিন ও চীন বাণিজ্য যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে চীনে লগ্নিকারী বিদেশি ৩২৪টি বিদেশি কোম্পানিকে ভারতে কারখানা খুলতে বিভিন্ন সুযোগ ও সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত সরকার। কেন্দ্রীয় শিল্প মন্ত্রকের অন্তর্গত ডিপার্টমেন্ট অফ প্রমোশন অফ ইন্ড্রাস্ট্রি অ্যান্ড ইন্ট্রারনাল ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্ট ইন্ডিয়া বিষয়টি খসড়া তৈরি করেছে। যা চীনের অর্থনীতিতে বড়সড় আঘাত হানবে বলে চীন ভয় পাচ্ছে।
একদিকে ভারত জম্মু কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা উঠিয়ে দেওয়াই ও ভারতের ভূখণ্ডে তিব্বতি সরকার স্থাপন করায় দখলীকৃত তিব্বত নিয়ে যেমন ভূমিখন্ড হারোনোর সঙ্কট তৈরি হয়েছে তেমনই দক্ষিণ চিন সাগরে বৃহৎ প্রাকৃতিক গ্যাসের সন্ধান পেলে সেই ক্ষেত্র জাপানের দাবিতেও আমারিকা পাশে থাকায় চীন তা অধিগ্ৰহণ না করতে পারায় চীনকে আরও ক্ষেপিয়ে তুলছে। উইঘর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ চীন প্রদেশ জিনজিয়াং দীর্ঘদিন ধরে স্বাধীনতার দাবি করছে। বিল কিল্টন থেকে ওবামা প্রশাসনের সমর্থন চীনকে সরকারকে দীর্ঘদিন ধরে কূটনৈতিক ভাবে এই বিষয়ে কিছুটা ব্যাকফুটে রেখেছে।
বিশ্ব বাণিজ্য দখলে আমেরিকার প্রথম আঘাত ও অভ্যন্তরীন সুবিধাজনক ভূমিখন্ড হারানোর ভয় চীনকে ভারতের বিরুদ্ধে আগ্ৰাসী করে তুলেছে বলে কূটনীতিবিদরা মনে করছেন। পাকিস্তান, নেপাল, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কাকে অর্থনৈতিক ঋণের সুবিধা, বন্দর বাণিজ্যের সুবিধা দিলেও ভারতের উত্থান কূটনৈতিকভাবে থামানো যাচ্ছিল না। যেমন তেমন বিশ্ববাণিজ্য যুদ্ধে আমেরিকার সরাসরি আঘাতে এই প্রথম ধাক্কা খেতে শুরু করেছে চীনের বিশ্বশক্তি হওয়ার এতদিনের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন পূরণ করতেই চীনের নতুন কৌশল ভারতীয় সীমান্তে যুদ্ধের সম্ভবনা তৈরি করা। যেহেতু চিনের এই পদক্ষেপ পূর্বপরিকল্পিত সুতরাং বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন বেশ ক্ষতি হবে ভারতেরই। আর যুদ্ধ মানেই ক্ষতি হলেও চিন অনেকটা লাভ ওঠাবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আমেরিকা সহ ইউরোপ বাধ্য হবে শান্তি চুক্তিতে চীনের শর্ত মানতে। কারণ অর্থনীতি ও রাজনৈতিক ক্ষমতার ভরকেন্দ্র এখন চীনের দিকে হেলে। এই কৌশলে ক্রমাগত পাকিস্তান সীমান্তের মতো ভারত চীন সীমান্তে রক্তক্ষরণ ঘটানো সম্ভব হবে। তেমন চীন নিয়ে ভারতের তিব্বত ও বাণিজ্য কূটনীতি কার্যকর হতে বাধাপ্রাপ্ত হবে।
এই সীমান্ত সংঘর্ষে চীন করোনা বিতর্ক, হংকং অধিগ্ৰহণ ও দক্ষিণ চীন সমুদ্র নিয়ে আমেরিকা, জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়ার যে ক্রমাগত চাপ তৈরি করেছিল তার নজর অনেকটাই ঘুরিয়ে দিতে পেরেছে। আমেরিকাকে বাধ্য করেছে নেটো বাহিনীর একটি অংশ পূর্ব এশিয়ায় নিয়ে আসার ভাবনাচিন্তা করতে। এই মুহূর্তে অর্থনৈতিকভাবে সঙ্কটে থাকা আমেরিকা যুদ্ধে ভারতের সঙ্গে যোগ দেবে না। ভারতকেও যেকোনো ভাবে আলোচনার টেবিলে আসতে হবে। প্রত্যক্ষ যুদ্ধে চীনকে হারানো খুব কঠিন। যদিও আরও একদল বিশেষজ্ঞ মনে করছেন ভারতের অভিজ্ঞতা ভারতকে চীনের তুলনায় সম্মুখ সমরে অনেকটাই এগিয়ে রাখবে। তা সত্ত্বেও সীমান্তে যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে কূটনৈতিক কৌশলে চীন এখন অনেকটাই এগিয়ে। যুদ্ধে অথবা কূটনৈতিক টেবিলে লাভ কিন্তু হবে চীনের। তবে এই পরিস্থিতিতে এখন দেখার শুধু ভারতের নতুন কৌশলের দিকে।