ইতিহাস ফিসফিস কথা কয়..বোলপুরের রাইপুর রাজবাড়ি

সুকেশ মণ্ডল : বোলপুর শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমে ইলামবাজার যেতে বা ধারেই পরে বীরভূম জেলার এক ঐতিহাসিক গ্রাম রাইপুর। এই গ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাসের নানা ঘটনাবলী। বলা যেতে পারে রাইপুরে কালে কালে সৃষ্টি হয়েছে নানা ইতিহাস যার দরুন রাইপুর সকলের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। রাইপুরের নাম কিভাবে এল তা নিয়ে দুটি মত শোনা যায়।

এক মত অনুসারে অজয় নদের তীরে আদমপুরই ছিল রাইপুর গড়ে ওঠার পূর্বে ঐ স্থানের লোকের বসবাসকারী গ্রাম। অজয়ের বন্যার ফলে আদমপুর ছেড়ে সকলে আরও উত্তরদিকে উঠে আসতে লাগলেন এবং নতুন বসতি স্থাপন করলেন। রায়চৌধুরীরা তৎকালে জমিদার ছিল বলেই নতুন গ্রামটির নাম হয় রায়পুর। আর একটি মতানুযায়ী রাইপুরের সিংহ পরিবার হতেই এরূপ নাম আসে। লালচাঁদের বংশে বিশ্বম্ভর সিংহ বর্ধমানের রাজার থেকে ‘রায়’ খেতাব পাওয়ায়, আদমপুর পরবর্তীকালে ‘রায়পুর’ বা রাইপুর নামে পরিচিত হয়।

চৌধুরী পরিবার : রাইপুর নামে গ্রামটি গড়ে ওঠার আগে রায়চৌধুরীরা ছিল আদমপুরের জমিদার। পরবর্তীকালে এরা রাইপুরে উঠে আসে। রাইপুরে এই পরিবার গোপীনাথ জিউয়ের মন্দির স্থাপন করে গোপীনাথ ও রাধারানীর নিত্য ভোগের দেবসেবার চালু করেছিলেন। এই মন্দির আজও বর্তমান। জিতানাথ দত্ত ছিলেন এই পরিবারের সন্তান। মুর্শিদাবাদের নবাব আলীবর্দির আমলে রাইপুর গ্রামের জিতানাথ ১৭৪০ সালে মুর্শিদাবাদে দশ হাজার সেনার সেনাপতি পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। ঐ সময় বাংলায় ভয়াবহ বর্গী আক্রমণ ঘটে, জিতানাথ অজয় নদের তীরে কাটোয়া থেকে জয়দেব পর্যন্ত তাঁর দশ হাজার সেনা সমাবেশ করেন। পাশের গ্রাম সুপুরের আনন্দচাঁদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে এই বাহিনী বর্গী আক্রমণকে প্রতিহত করতে সমর্থ হয়। এই খবর শোনার পর আলিবর্দী জিতানাথ দত্তচৌধুরীকে ‘রায়চৌধুরী’ উপাধি দেন এবং পুরষ্কার বাবদ এক হাজার টাকা ও তাঁর বাড়ির গোপীনাথ ঠাকুরের নামে এক হাজার বিঘা জমি দান করেন।

সিংহ পরিবার : এই গ্রামেই অবস্থিত ভগ্নপ্রায় জমিদার বাড়ি (লোকমুখে প্রচলিত রাজবাড়ি) আজও ইতিহাসের নানা সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। ব্রিটিশ শাসিত বাংলায় যতগুলি পরিবার খ্যাতি অর্জন করেছিল তার মধ্যে অন্যতম এই জমিদার পরিবার। ১৭৬৪ সালে মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনা হতে সিংহ পরিবারের আদিপুরুষ লালচাঁদ দে অজয় নদের তীরে রাইপুর গ্রামে আসেন, এবং অধুনা মা মঙ্গলচন্ডী বাড়ির নিকট বসতি স্থাপন করেন। ইনি এক সহস্র তন্তুবায় পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে বীরভূমে এসেছিলেন। এই তন্তুবায় পরিবারগুলিকে বীরভূমের মির্জাপুর, চন্দনপুর, রাইপুর, সুখবাজার, সুরুল, সিয়ান প্রভৃতি গ্রামগুলিতে সমৃদ্ধি এনেছিল। সেই সময় চৌধুরীদের অবস্থার অবনতি হয়। ১৭৭০ সালে রাইপুর চৌধুরীদের নিকট হতে জমিদারী ক্রয় করে লালচাঁদ স্থানীয় জমিদার রূপে পরিগনিত হয়। লালচাঁদের তিন পুত্র ছিল পঞ্চানন, রামকিশোর ও শ্যামকিশোর। ১৭৭৩ সালে লালচাঁদ ৬০ বিঘা জমির উপর তিন ছেলের জন্য তিনটি মহল্লা বাড়ি তৈরি করেন। এগুলিতে মোট ১২০ টি ঘর ছিল। লালচাঁদের কনিষ্ঠপুত্র শ্যামকিশোর ১৮০০ সালে জন চীপের অধীনে মাসিক কুড়ি টাকা বেতনে দেওয়ান পদে নিযুক্ত হন। চীপকুঠীতে ‘গরার’ মোটা থানের ব্যবসা ছিল। তখনকার দিনে এই কাপড় জাহাজ ও নৌকাতে ব্যবহার হতো। ফলে ইউরোপের বাজারে এর চাহিদা ছিল প্রবল।

শ্যামকিশোর ঐ হাজার তন্তুবায় পরিবার দ্বারা উদপাদিত কাপড় চীপ সাহেবের কাছে যোগান দিতেন। পরিবর্তে প্রত্যেক হাজার পরিবার পিছু এক টাকা করে দৈনিক এক হাজার টাকা নজরানা পেতেন। এই ব্যবসার মধ্য দিয়ে রাইপুরের জমিদার পরিবার প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে থাকে। ইনি পরবর্তীকালে রাজনগরের রাজার নিকট থেকে সমস্ত সম্পত্তি এবং শ্যামবাটি, ভুবনডাঙ্গা মৌজা কিনে নেন। এখানে বলে রাখা ভালো যে বর্তমান শ্যামবাটি জায়গাটির নামকরণ তাঁর নামানুসারেই হয়েছিল। শ্যামকিশোরের চার পুত্র ছিলেন জগমোহন, ব্রজমোহন, ভুবনমোহন ও মনমোহন। শ্যামকিশোর তাঁর বড়ো ছেলে জগমোহনের নামে সমস্ত জমিদারী ক্রয় করেছিলেন। তিনি শুধু জমিদারী পরিচালনা করতেন। জগমোহনের জ্যেষ্ঠপুত্র বিশ্বম্ভর খুব বুদ্ধিমান ও তেজস্বী পুরুষ ছিলেন। তিনি বর্ধমানের মহারাজা তিলকচাঁদ মহাতাভের দেওয়ান ছিলেন। তাঁর নামে প্রবাদ বচন চালু ছিল- ‘যাহা বিশ্বম্ভর, তাহাই রাইপুর।’ বর্ধমানের মহারাজ তাকে ‘রায়’ উপাধি দান করেন। সম্ভবত এই ‘রায়’ উপাধি হতেই গ্রামের নাম হয় ‘রায়পুর’ বা ‘রাইপুর’।

বীরভূমের গৌরব লর্ড সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহ, যিনি সবার কাছে লর্ড এস. পি. সিংহ নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন সিতিকন্ঠ সিংহের কনিষ্ঠ পুত্র। ১৮৬৩ সালের ২৪ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মাতার নাম মনোমোহিনী দেবী। তাঁর দরুনই আজ রাইপুর জমিদারবাড়ির এত নাম ডাক। ১৮৭৭ সালে মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে তিনি বীরভূম জিলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করেন। ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে বি.এ. পরীক্ষা না দিয়ে অগ্রজ চিকিৎসক নরেন্দ্র প্রসন্নের সঙ্গে গোপনে ইংল্যান্ডে যান হেনরী আরস্কিনের সহায়তায়। তখনকার দিনে কালাপানি পার হওয়ার অপরাধে দুই ভাই জাতিচ্যুত হয়। পরবর্তীকালে গ্রামে ফিরলে জমিদার বাড়িতে প্রবেশ করার অধিকার তাঁর ক্ষুণ্ণ হয়। ১৮৮৬ সালে ‘লিঙ্কনস ইন’ থেকে ব্যারিস্টার পাস করে সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। সিতিকন্ঠ সিংহের নামধারী ‘রাইপুর সিতিকন্ঠ স্মৃতি উচ্চবিদ্যালয়’ আজও জ্ঞানের আলো বিতরণ করে চলেছে। এই বিদ্যালয়টি ১৯০২ সালে সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯১৫ সালের ২৭ শে ডিসেম্বর জাতীয় কংগ্রেসের বোম্বাই অধিবেশনে স্যার সতেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহ জাতীয় কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯২০ সালে বিহার-ঊড়িষ্যার গভর্নর পদে তিনি নিযুক্ত হন।

কালের নিয়মে এই রাজ বাড়িও আজ ইতিহাসের পাতায় রয়ে গেছে। এর জীর্নতা তাই একে গ্রাস করে চলেছে ক্রমশ। প্রাসাদের একেবারে উপরে উঠে রাইপুর ও অজয় নদের সংলগ্ন স্থানের দিকে তাকালে মনে হয় আজও যেন এই বাড়ির ইতিহাস গায়ে শিহরিত হয়ে মুখপানে চেয়ে থাকে। যে জমিদার বাড়ি একসময় মানুষের ভিড়ে সমাগম করত, আজ সকলের চক্ষুরালে কেবল তা ধ্বংস হবার প্রহরী গুনে চলছে।