নিজস্ব প্রতিবেদন : বাংলার রাজনৈতিক ময়দানে দলবদল নিয়ে শুরু হয়েছে এক নতুন ধরনের রাজনীতি। দলবদলের বা ঘোড়া কেনাবেচার রাজনীতি উত্তর ভারতে দেখা গেলেও বাংলায় রাজনৈতিক চালচিত্রে তা ছিল না এতদিন।
পঞ্চাশের দশকে ‘কমিউনিস্ট পার্টি ওফ ইন্ডিয়া’ ভেঙে ‘কমিউনিস্ট পার্টি ইন্ডিয়া (মার্ক্সিস্ট)’ তৈরি হয়। বাংলার দুই দলের কমিউনিস্ট নেতারা দুই দলে গেলেও তাদের রাজনৈতিক আদর্শের পরিবর্তন হয়নি। বাংলায় কংগ্ৰেস ভেঙে ‘বাংলা-কংগ্ৰেস’ তৈরির সময়েও কংগ্ৰেস নেতাদের রাজনৈতিক অবস্থানের পরিবর্তন হয়নি।
ওয়াকিবহাল মহলের দাবি, বাংলায় কংগ্ৰেস বা বাম ঘরানার রাজনীতিতে গণহারে দলবদলের সূত্রপাত হয় তৃণমূলের উত্থানের পর। যেখানে রাজনৈতিক আদর্শ নয় রাজনৈতিক স্বার্থে দলবদলের রাজনীতি শুরু হয়। কংগ্ৰেসের বিভিন্ন নেতাকে তৃণমূলে নিয়ে আসার নীতি নেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সেই একই নীতির প্রয়োগ মমতার একসময়ের দলবদলের কারিগর মুকুল রায়কে দিয়ে বিজেপি শুরু করে করলে বাংলায় শুরু হয় গণহারে রাজনৈতিক দলবদল, পাল্টা দলবদলের রাজনীতি। দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ক্ষোভ ইত্যাদি থেকে নেতানেত্রীরা এখন এই খেলায় মত্ত।
এই রাজনীতির শেষ কোথায় তা জানা নেই বাংলার কোন রাজনৈতিক দলের। অবিশ্বাস, সন্দেহ, বিশ্বাসভঙ্গের রাজনীতিতে স্পষ্ট নয় কোন রাজনৈতিক নেতার অবস্থান।
১৯৯৮ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অজিত পাঁজা, মুকুল রায়, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, কানোয়ার দীপ সিং, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো নেতৃত্ব কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করেন। বাংলা থেকে কংগ্ৰেসের অস্তিত্ব মুছে দিয়ে তৃণমূলকে শাসক বামফ্রন্টের প্রধান বিরোধী দল হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার নীতি নেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
অভিযোগ, ২০১৬ সালে বিধানসভা ভোটের সময় থেকে বহু নেতা তৃণমূলে নিয়ে আসার কাজ শুরু। যা একপ্রকার দলবদলের শুনামিতে পরিণত হয়।
গুরুত্বপূর্ণ নেতা যাঁরা দলবদল করেছেন
১) বামফ্রন্টের রেজ্জাক মোল্লা, উদয়ন গুহ।
২) কংগ্রেসের বরিষ্ঠ নেতা ও নেতাজীর ভাইপো শিশির বসুর স্ত্রীও কৃষ্ণা বসু।
৩) সৌমেন মিত্র ২০০৮ সালে কংগ্রেস ছেড়ে প্রগতিশীল কংগ্ৰেস দল গঠন করেন। যাকে ২০০৯ সালে তিনি তৃণমূলের কংগ্ৰেসের সঙ্গে মিশিয়ে দেন। সাংসদ হন তৃণমূল থেকে। যদিও ২০১৪ সালে তৃণমূল ছেড়ে তিনি কংগ্ৰেসে ফিরে যান।
৪) মানস ভুঁইয়া ২০১৬ সালে কংগ্ৰেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেন।
৫) মালদার কংগ্ৰেস পরিবারের মৌসম নুর।
৬) টিম রাহুলের মুহুয়া মৈত্রর মতো উচ্চশিক্ষিত নেত্রীকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্ৰেস থেকে তৃণমূলে আনতে সক্ষম হন।
৭) দীনেশ ত্রিবেদী কংগ্ৰেস থেকে এসে তৃণমূল থেকে রেলমন্ত্রী পর্যন্ত হন।
৮) সুব্রত মুখার্জী কংগ্ৰেসের মন্ত্রী ছিলেন। বর্তমানে তিনি তৃণমূলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা।
৯) সৌগত রায় অধ্যাপক ও রাজনীতিবিদ। কংগ্ৰেস থেকে তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পর সংসদে তিনি বর্তমানে কংগ্ৰেসের প্রধান মুখ।
১০) মালা রায় শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন বাংলায় কংগ্ৰেসের নির্ভরযোগ্য নেতা। কিন্তু তিনিও স্বামী নির্বেদ রায়ের সঙ্গে তৃণমূলে কংগ্ৰেসে দেন।
১১) হুমায়ন কবির, যিনি কংগ্রেস থেকে তৃণমূল, পরে বিজেপি এবং পরে আবার তৃণমূলে যোগ দেন।
১২) ফিরহাদ হাকিম, যিনি এখন তৃণমূলের অন্যতম কান্ডারি তিনি ১৯৯৮ সালে জাতীয় কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে আসেন।
১৩) মেদিনীপুরের দীর্ঘদিনের কংগ্রেসের শক্তিশালী নেতা শিশির আধিকারির তৃণমূলে যোগদান তৃণমূলের কংগ্ৰেসের কাছে বড় জয় ছিল।
১৪) মুকুল রায়, যিনি কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে এসে একসময় তৃণমূলের দ্বিতীয় স্তম্ভ হয়ে দাঁড়ান। কিন্তু পরে দলের সাথে বনিবনা হওয়ায় বিজেপিতে যোগ এবং বর্তমানে বিজেপির সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি।
১৫) বর্তমান রাজনীতির সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি শুভেন্দু অধিকারী প্রথম তিন বছর জাতীয় কংগ্রেসের থাকার পর তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেন। আর এরপর দলের সাথে সম্পর্ক চরম তিক্ততায় পৌঁছাতেই সদ্য অমিত শাহের হাত ধরে বিজেপিতে এসেছেন।
এছাড়াও এই তালিকায় রয়েছেন রাজ্যের আরও একাধিক নেতানেত্রী যারাও বর্তমানে রাজ্য রাজনীতির অন্যতম মুখ হয়ে উঠছেন।
আর এই দলবদলের পরিসংখ্যান দেখে ওয়াকিবহাল মহলের মন্তব্য, যে দলবদলের রাজনীতি তৃণমূল বাংলায় নেয় ১৯৯৮ থেকে থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে সেই একই নীতি বিজেপি বাংলায় তৃণমূলের উপর প্রয়োগ করে দেখিয়ে দেয় তৃণমূলের নীতিগত রাজনৈতিক ভুল রণকৌশল। যা এখন বুমেরাং হয়ে তৃণমূলের উপরেই আছড়ে পড়ছে।