পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত ৯টি কালী মন্দির

নিজস্ব প্রতিবেদন : দেবী দুর্গার আরেক রূপ হলেন দেবী কালী। আর দীপাবলীর দিন‌ আমরা এই দেবীর-ই আরাধনা করি। বাঙালিরা দেবী কালিকাকে মাতৃরূপেই আরাধনা করেন।
সমগ্র দেশের পাশাপাশি আমাদের পশ্চিমবঙ্গেও দেবীর নানা বিখ্যাত মন্দির আছে। পশ্চিমবঙ্গের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই সকল মন্দিরগুলির কথা আজকে বলবো।

পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত ৯টি কালী মন্দির

১) কিরীটেশ্বরী মন্দির : মুর্শিদাবাদ জেলায় অবস্থিত কিরীটেশ্বরী মন্দির হল অন্যতম একটি শক্তিপীঠ। এই মন্দির মুকুটশ্বরী মন্দির নামেও পরিচিত। আসল মন্দিরটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। উনিশ শতকে রাজা দর্পনারায়ণ এই নতুন মন্দির নির্মাণ করেন। পুরান মতে এখানে দেবী সতীর কিরীট অর্থাৎ মুকুটের কনা পড়েছিল। তাই এই মন্দির কিরীটেশ্বরী নামে পরিচিত। এই পিঠে দেবী ‘বিমলা’ ও তার ভৈরব ‘সম্বর্ত’ নামে পূজিত হন।

তবে এই মন্দিরে কোনো দেবী প্রতিমা নেই। এখানে বেদীর উপর আরেকটি ছোট বেদী আছে যা দেবীর কিরীট বলে পূজিত। প্রতি বছর এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে পৌষ মাসে কিরীটেশ্বরী মেলা বসে। এখানে মূল মন্দিরের চারিদিকে আর ও অনেক ছোট ছোট মন্দির আছে।

ইতিহাসে বলে, মুর্শিদাবাদের নবাব মীরজাফর আলী খান কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হলে শেষ জীবনে তার হিন্দু দেওয়ানের পরামর্শ অনুযায়ী কিরীটেশ্বরী দেবীর চরণামৃত প্রাণ করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন।

২) কালীঘাট মন্দির : কলকাতার কালীঘাট মন্দির ৫১ পীঠের মধ্যে অন্যতম একটি পীঠ। এখানে সতীর ডানপায়ের চারটি আঙ্গুল পতিত হয়েছিলো। মতান্তরে দেবীর ডান পায়ের বুড়ো আঙ্গুলটি পতিত হয়েছিলো। বরিশার সাবর্ণ জমিদার শিবদাস চৌধুরীর আনুকূল্যে গড়ে উঠেছিল এই মন্দির। এই মন্দিরে দেবী দক্ষিনাকালী পূজিতা হন। এখানে পীঠ রক্ষক দেবতা হলেন নকুলেশ্বর।

মূল মন্দির সংলগ্ন অনেকগুলি ছোট ছোট মন্দির যেমন রাধা কৃষ্ণের মন্দির শিবের মন্দির ইত্যাদি আছে। বঙ্গীয় আটচালা রীতিতে এই মন্দির তৈরি হয়। এই মন্দির তৈরি হওয়া প্রসঙ্গে নানারকম কাহিনী আছে। কথিত আছে, একজন ভক্ত ভাগীরথী নদীর তীরে একটি উজ্জ্বল আলোর রেখা দেখতে পেয়েছিলেন পরে তিনি খুঁজে দেখেন যে সেখানে মানুষের পায়ের পাতার আকারের একটি প্রস্তরখন্ড আছে, আর সেই প্রস্তরখণ্ড থেকে আলোর ছটা আসছে। এরপর সেই প্রস্তরখন্ডের কাছেই নকুলেশ্বর ভৈরবের একটি শিবলিঙ্গ খুঁজে পান সেই ভক্ত। কালক্রমে এটি মহাতীর্থ কালীঘাট হয়ে ওঠে। আত্মারাম ব্রহ্মচারী ও ব্রহ্মানন্দ গিরি নামে দুই জন সন্ন্যাসী কষ্টি পাথরের উপর দেবীর এই বিশেষ রূপের রূপদান করেছিলেন।

৩) তারাপীঠ মন্দির : বীরভূমের তারাপীঠ মন্দির অন্যতম একটি শক্তিপীঠ রূপে পরিচিত। কেউ কেউ দাবি করেন এই মন্দিরে দাক্ষায়ণী সতীর তৃতীয় নয়ন তারা পড়েছিল। পরবর্তীকালে ঋষি বশিষ্ঠ এই দৈব প্রস্তরীভূত খণ্ড পান। কথিত আছে, ঋষি বশিষ্ঠ সতীকে পুজো করেন তারা রূপে কিন্তু প্রথমে তিনি অসফল হন। এরপর তিনি তিব্বতে গিয়ে ভগবান বিষ্ণুর অপর অবতার বিষ্ণুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তখন ভগবান বুদ্ধ তাকে বাম মার্গে মদ্য মাংসাদি পঞ্চমকার সহ তারা দেবীর পুজো করতে বলেন। ভগবান বুদ্ধের উপদেশ অনুসারে বশিষ্ট্য তারাপীঠে এসে তিন লক্ষ বার তারা মন্ত্র জপ করেন। তখন দেবী তারা খুশি হয়ে তাকে দর্শন দেন। দেবী তখন ঋষি বশিষ্ঠকে শিবকে স্তন্যপানরতা অবস্থায় দর্শন দিয়েছিলেন। সেই থেকে তারাপীঠের তারাদেবী এই রূপে পূজিতা হয়ে আসছেন।

দেবীর এই রূপ প্রসঙ্গে বলা হয় যে সমুদ্রমন্থনের সময় সমুদ্রগর্ভ থেকে উত্থিত বিষ কন্ঠে ধারণ করার পরে মহাদেব যন্ত্রণায় ছটফট করতে শুরু করেন। তখন তারা দেবী শিবকে আপন স্তন্য পান করিয়ে তার জ্বালা নিবারণ করেছিলেন।

প্রসঙ্গত, তারাপীঠ মন্দিরের সঙ্গে জড়িত আছেন সাধক বামাক্ষ্যাপাও। সাধক বামাক্ষ্যাপা ছিলেন মায়ের একনিষ্ঠ ভক্ত। তার ভক্তিমার্গ ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। তিনি দেবীকে নৈবেদ্য নিবেদনের পূর্বে নিজে খেতেন। এই ঘটনা তৎকালীন ব্রাহ্মণ সমাজের কানে গেলে তারা এই আচরণের তীব্র বিরোধিতা করতে শুরু করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে তারা দেবী নাটোরের মহারানীকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে নিজে আদেশ দেন যে দেবীরপুত্র বামাক্ষ্যাপাকে প্রথমে ভোজন করাতে।

সেই থেকে তারাপীঠে দেবীকে নৈবেদ্য নিবেদনের পূর্বে বামাক্ষ্যাপাকে ভোজন দেওয়া হতো। শোনা যায় সাধক বামাক্ষ্যাপাকে দেবী শ্মশান ক্ষেত্রে ভীষণ রূপে দর্শন দিয়ে স্তন্যপান করিয়েছিলেন।

৪) দক্ষিণেশ্বর মন্দির : ১৮৪৭ সালে জানবাজারের রানী রাসমণী স্বপ্নে মা কালীর আদেশ পেয়ে দক্ষিণেশ্বরে এই মন্দির তৈরীর কাজ শুরু করেন। এই মন্দির তৈরির কাজ শেষ ‌হয়েছিলো ১৮৫৫ সালে। এই মন্দিরের সঙ্গে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ও তার সহধর্মিণী জগৎজননী সারদা দেবীর নাম যুক্ত থাকায় এই মন্দির তীর্থক্ষেত্র সমান হয়ে উঠেছে। এই মন্দিরের দেবী ভবতারিণী। এই মন্দির একশো ফুটেরও উঁচু। এই কালীমন্দির নবরত্ন ধাঁচের তৈরি। মূল মন্দিরটি কেন্দ্র করে রয়েছে রাধাকান্ত মন্দির ও দ্বাদশ শিব মন্দির। এই মন্দিরের সহস্র পাপড়ির রূপের পদ্মের উপর শায়িত আছেন মহাদেব। সেই শায়িত মহাদেবের উপর পা দিয়ে আছেন ভবতারিণী দেবী। এই দেবী অত্যন্ত জাগ্রত। দূরদূরান্ত থেকে ভক্তরা মনস্কামনা নিয়ে দেবীর কাছে পুজো দিতে আসেন।

৫) কঙ্কালীতলা মন্দির : এই মন্দির বোলপুরে অবস্থিত। ৫১ পীঠের অন্যতম একটি শক্তিপীঠ হলো এই মন্দির। এখানে দেবীর নাম দেবগর্ভা। এখানে পীঠ রক্ষক ভৈরবের নাম রুরু। কঙ্কালীতলা মন্দিরের পাশে একটি কুন্ড কিছু পাথর আছে। অনেকে এগুলোকেই দেবীর দেহাংশ বলেন। ২০ বছর পর এই পাথরগুলিকে তোলা হয়। পুজো শেষ হলে এই পাথরগুলিকে আগের জায়গায় রেখে দেওয়া হয়। আর এই মন্দিরের পাশের শ্মশানে গুপ্ত তন্ত্র সাধনা করা হয়। বলা হয় যে এই মন্দিরে দেবী সতীর কঙ্কাল বা কোমর পতিত হয়েছিল।

৬) কনকদুর্গা মন্দির : পশ্চিম মেদিনীপুরের ঝাড়গ্রামের কাছে রয়েছে এই মন্দির। ৪৩৫ বছর আগে এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই মন্দিরের সঙ্গে জড়িত রয়েছে সামন্ত রাজাদের ইতিহাস। ঝাড়গাম থেকে ১৫ কিমি দূরে ডুলুং নদীর তীরে গভীর জঙ্গলের মধ্যে রয়েছে কনক দুর্গা মন্দির। এখানে রয়েছে অশ্বারোহিনী চতুর্ভূজা দেবী। এই দেবীমূর্তি অষ্ট ধাতুর তৈরি। কথিত আছে যে চিল্কিগড়ের সামন্ত রাজা গোপীনাথ সিংহ স্বপ্নাদেশ পেয়ে স্ত্রীর হাতের কাঁকন দিয়ে এই মূর্তি তৈরি করেন। কথিত আছে, এই মন্দিরে আগে নরবলি হতো তবে দেবীর নির্দেশে তা বন্ধ হয়ে যায়। যদিও আজও এই মন্দিরে অষ্টমীর রাতে পাঁঠাবলি হয়।

৭) সর্বমঙ্গলা মন্দির : গড়বেতায় সর্বমঙ্গলা মন্দির রয়েছে। গুপ্তযুগে কুমার গুপ্তের রাজত্বকালে তার সৌজন্যে বেত্র বর্মা এই নগরটি প্রতিষ্ঠা করেন। সম্ভবত বেত্র বর্মা এই শহর রক্ষা করবার জন্য একটি গড় নির্মাণ করেছিলেন তাই প্রথমদিকে এই শহরের নাম ছিল বেত্র গড়। পরবর্তীতে এই জায়গার নাম হয় গরবেত্রা ও পরে গরবেতা।

কথিত আছে, রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজত্বকালে বাগরি রাজ্যে একজন ঋষি আছেন। তিনি এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে অভিভূত হয়ে যান। তারপর তিনি সেখানে সর্বমঙ্গলা দেবীর মন্দিরটি নির্মাণ করেন। রাজা বিক্রমাদিত্য এরপর গড়বেতা এসেছিলেন এবং তিনি মৃতদেহের উপর শব সাধনা শুরু করে নিজেকে নিবেদিত করেন। তার ঐকান্তিক সাধনায় তুষ্ট হয়ে দেবী সর্বমঙ্গলা তাকে তথাকথিত অতিপ্রাকৃত চরিত্র তাল বেতালের উপর কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা দিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন। দেবীর আশীর্বাদের সাফল্যের প্রমাণ দেওয়ার জন্য বিক্রমাদিত্য তাল বেতাল কে মন্দিরের মুখ দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে করার নির্দেশ দেন। তাল বেতাল অবিলম্বে সেই নির্দেশ কার্যকর করে দেয়। কথিত আছে, অতিপ্রাকৃত চরিত্র বেতালের নাম অনুসারে এই জায়গার নাম হয় বেতা।

৮) হংসেশ্বরী মন্দির : পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার বাঁশবেড়িয়ায় অবস্থিত এই কালীমন্দির। রাজা নৃসিংহ দেব ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে এই কালী মন্দিরের নির্মাণ শুরু করেন পরবর্তীতে রাজার মৃত্যু হলে তার বিধবা পত্নী রানী শঙ্করী ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে এই মন্দির নির্মাণ সম্পন্ন করেন। গোলাকার বেদীর ওপর পাথরে নির্মিত শায়িত শিব মূর্তির নাভি থেকে সৃষ্টি হওয়া প্রস্ফুটিত পদ্মের ওপর দেবী হংসেশ্বরীর মন্দির নির্মিত। দেবী ত্রিনয়না, চতুর্ভূজা, খড়্গধারিণী ও নরমুণ্ডধারিণী। দেবী এখানে নীল বর্ণা। এই মন্দিরে ১৩টি রত্ন ও মিনার প্রতিটি প্রস্ফুটিত পদ্মের মত দেখতে। এই মন্দিরের গর্ভগৃহের উচ্চতা ৭০ ফুট। এই মন্দিরের পাশেই রয়েছে টেরাকোটার অনন্ত বাসুদেব মন্দির।

৯) ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দির : কলকাতার মধ্যে অবস্থিত এই মন্দির আজও অখ্যাত। অনেকেই আছেন যারা এই মন্দিরের নামটুকু শোনেননি। এইখানে মূর্তির পায়ের কাছে রয়েছে পঞ্চদেবতা। রুদ্র, ঈশ্বর ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর। শিবের নাভি থেকে বের হ‌ওয়া একটি)পদ্মের উপর রয়েছেন কালী মূর্তি ইনিই ত্রিপুরা সুন্দরী দেবী।