কেউ মানসিক অবসাদে ভুগছেন কিনা জানুন ১০টি লক্ষণে, রইলো প্রতিকারের উপায়

নিজস্ব প্রতিবেদন : মানসিক অবসাদ আবারও নিয়ে নিল একটি তরতাজা তারকার প্রাণ। গতকাল তরুণ অভিনেতা ও বলিউড হার্টথ্রব সুশান্ত সিং রাজপুতের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হলো তার বান্দ্রার ফ্ল্যাট থেকে। জানা গিয়েছে দীর্ঘদিন ধরে মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন তিনি। তার জেরেই নাকি এই চরম সিদ্ধান্ত। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে কেরিয়ারের ভালো একটি সময়ে তার নেওয়া এই চরম সিদ্ধান্ত যেন আবারও ভারতবাসীকে বুঝিয়ে দিয়ে গেল যে শারীরিক স্বাস্থ্যের মতই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মানসিক স্বাস্থ্য।

দেশের আনাচে কানাচে রোজ কত মানুষকে অবসাদের কারণে প্রাণ হারাতে হয় সেই তথ্য আমরা সবাই হয়ত জানিনা। পরিস্থিতি চুপিসারে বুঝিয়ে দিচ্ছে অগ্রাধিকার দিতে হবে মানসিক স্বাস্থ্যকেও। নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের সাথে সাথে আশেপাশের মানুষদের মানসিক স্বাস্থ্যকেও গুরুত্ব দিতে হবে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে প্রতি দেশের জনসংখ্যার ১০ থেকে ২০ শতাংশ মানুষ মানসিক অবসাদের শিকার হন এবং সাথে এও দেখা গেছে যে পুরুষদের তুলনায় দ্বিগুণ মহিলারা এই রোগের শিকার বেশি। আগে মনে করা হতো বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যেই এই রোগ বেশী হয় কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সাধারণত ১৮ থেকে ৪৪ বছর বয়সী ছেলমেয়েদের এই রোগের শিকার হতে হয়।

যদি কোনো ব্যক্তির মাথায় সুইসাইডিয়াল চিন্তাভাবনা আসে বা সে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন সেক্ষেত্রে তাদের বেশ কিছু আচরণ থেকে তা প্রকাশ পায়। আবার অনেকে এমন আছেন যারা ভেতরে ভেতরে গুমড়ে মরলেও বাইরে কোনো মানুষকে সেটা বুঝতে দেন না। ব্যক্তিগত জীবনে নানা ওঠা পড়া, কর্মজীবনে বড় কোনো ক্ষতি, কোনো স্বপ্ন ভেঙে যাওয়া ইত্যাদি থেকে মানুষের মধ্যে মানসিক অবসাদ আসে। সেই মানসিক অবসাদ দিনে দিনে হয়ে ওঠে আত্মহত্যার কারণ। এরকম পরিস্থিতিতে কোনো কাছের বন্ধু, পারিবারিক সদস্য এমনকি সেলিব্রিটির আত্মহত্যার খবর সেই ব্যক্তিকে প্রভাবিত করতে পারে।

মানসিক অবসাদ কি? মানসিক অবসাদ কেন হয়?

মানসিক অবসাদ একদিনে আসেনা, দিনের পর দিন নানান ঘটনায় কষ্ট পেতে পেতে মানুষের মনে অবসাদ আসে। মানসিক অবসাদ এবং মনখারাপ দুটি ভিন্ন জিনিস। মানসিক অবসাদে ব্যক্তির জীবনের ওপর সবরকম উৎসাহ হারিয়ে যেতে থাকে। কোনো খুশির ঘটনা ব্যক্তিকে খুশি দেয় না। ব্যক্তির নিজের কাছেই নিজের গুরুত্ব কমতে থাকে এবং তা থেকেই বাড়ে আত্মহত্যার প্রবণতা।

এই পরিস্থিতি থেকে মানুষকে বার করে আনতে পারে একমাত্র আশেপাশের মানুষদের বা ঘনিষ্ঠ মহলের মনোযোগ, পরিবারের লোকেদের ভালোবাসা। মানসিক অবসাদের কিছু সাধারণ লক্ষণ আছে যেগুলি দেখে বোঝার চেষ্টা করা যায় যে ব্যক্তির মানসিক অবসাদের শিকার হয়েছেন কিনা। ব্যক্তিগত সমস্যা ছাড়া আরও কিছু কারণে ব্যক্তি অবসাদের শিকার হতে পারেন।

১) জেনেটিক কারণ : পরিবারের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনের মধ্যে মানসিক অবসাদ থাকলে।

২) বায়োকেমিক্যাল কারণ : মস্তিস্কে অবস্থিত জৈব রাসায়নিক পদার্থগুলির ইমব্যালেন্সের জন্য।

৩) ব্যক্তিত্ব : বিশেষ ধরনের ব্যক্তিত্বের মধ্যে (উদ্বেগপ্রবণ, অল্পকিছুকে বড় মনে করা) এই রোগ বেশী হয়।

ডিপ্রেশনের শারীরিক লক্ষণ

নিম্নলিখিত ১০টি লক্ষণের মধ্যে যদি পাঁচটি বা তার বেশি লক্ষণ কোনও মানুষের মধ্যে টানা দুই সপ্তাহ বা তার বেশি থাকে, তবে তাঁকে মানসিক অবসাদগ্রস্ত রোগী বলা যায়।

১) অবসাদগ্রস্ত মানুষ জীবনকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা শুরু করে। নিজের প্রতি তার নিজের ঘৃণা এমন স্তরে চলে যায় যে সে ভাবে তার এবং তার আপনজনদের জীবনে ঘটে চলা সমস্ত নেতিবাচক ঘটনার জন্য সে নিজেই দায়ী।সেই কারণে তার মনে নিজের অস্তিত্ব মিটিয়ে দেওয়ার ভাবনা আসে।

২) অবসাদগ্রস্ত ব্যক্তি জীবনের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তার পছন্দের জিনিস, পছন্দের কাজ কোনোকিছুই আর তার ভালো লাগেনা। নিজের পছন্দের কাজগুলি তারা করতে ভুলে যায়, কোনো কিছুই তাদের আর আনন্দ দেয় না।

৩) অবসাদগ্রস্ত ব্যক্তি কোনো মানুষকে সহজে বিশ্বাস করতে পারেননা এবং তার মনে হয় যে কেউ তাকে বিশ্বাস করবেনা বা তার কথা বুঝবেনা যার ফলে সে আরও ভেতরে ভেতরে গুমড়ে যেতে থাকে। অনেকসময়ই দেখা যায় তারা নিজেদের সমস্যার মুখোমুখি দাড়াতে ভয় পায়। অন্য লোকের সাথে তো দুর নিজের সাথেই নিজের সমস্যা নিয়ে কথা বলতে চায়না। কথা বললে যদি কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে পড়ে! সেই ভয় নিজেদের সমস্যাগুলি তারা চেপে রাখে। মাঝে মাঝে যখন সেগুলি বিস্ফোরিত হয় তখন তার রূপ ভয়ঙ্কর হয়।

৪) অবসাদের ফলে ব্যক্তি সবসময় ক্লান্ত অনুভব করে, কোনোকিছু করতেই তার উৎসাহ লাগেনা যার ফলে অনেক ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ঘুম, ঘুমের সময়ের বদল ইত্যাদি উপসর্গ দেখা যায়।

৫) মানুষের ক্ষুধার উপর প্রভাব ফেলে অবসাদ। কারোর কারোর ক্ষিদে একদম পায়না, আবার কেউ কেউ সবসময় ক্ষুধার্ত বোধ করেন। যার ফলে হঠাৎ করেই তাদের ওজনের পরিবর্তন ঘটে।

৬) মানসিক অবসাদগ্রস্ত ব্যক্তি দুরকম সময়ের মধ্যে দিয়ে যান। কখনো কোনকিছুতেই তাদের খুশি, দুঃখ, রাগ কোনোটাই হয় না তো আবার কখনো তারা ভয়ঙ্কর রেগে যেতে পারেন বা ভীষণভাবে খুশি হতে পারে। তাদের আবেগের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না।

৭) তারা ভালো আছে নাকি খারাপ আছে তার উত্তর তারা নিজেরাই জানেন না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাকে এই প্রশ্ন করা হলে তারা যেন একটু বেশীই জোর দিয়ে বলেন যে তারা ভালো আছেন। কিন্তু নিজেরা এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে ভয় পান। কাউকে খারাপ আছি বললে যদি সামনের লোক বিচার করে, সেই ভয়েই প্রশ্ন এড়িয়ে যান তারা।

৮) ইচ্ছে করেই নিজের জন্য তারা এমন জীবন বেছে নেন যাতে নিজের সাথে নিজে সাক্ষাৎকার করার সময়ই অবশিষ্ট না থাকে। চাকরি, পড়াশোনা বা কাজের চাপ এত বেশী নিজেদের ঘাড়ে নিয়ে নেন যে তাতেই শেষমেষ তারা তলিয়ে যান। দিন শেষে অতিরিক্ত ক্লান্তি আর ভাবার সময় দেয়না। কাজটাকে যেন পালিয়ে যাওয়ার পথ হিসেবে বেছে নেন তারা।

৯) অনেক সময় ধরে নিজেকে চাপা দিতে দিতে অল্পতেই রেগে যান তারা। সামনের ব্যক্তির উপর সেই রাগের প্রকাশ ঘটে আবার নিজের ওপরও মারাত্বক একটা রাগ কাজ করে। জিনিসপত্র ছুঁড়ে দেওয়া থেকে চিৎকার, রাগের বহিঃপ্রকাশ ভয়ঙ্কর হয়। নিজেকেই অনেকসময় ক্ষতিগ্রস্ত করে দেন তারা। পরিস্থিতি শান্ত হলে অনেক ক্ষেত্রে তারা নিজেরাই বুঝতে পারেননা এত রাগের কারন কি ছিল? ফলে আবারও শুরু নিজেকে দোষারোপ করার পালা। আরও বেড়ে চলে অবসাদ।

১০) জীবনের প্রতি একটি তাচ্ছিল্য ভাব আসে। যা ঘটে ঘটুক, এরকম একটা মানসিকতায় এগিয়ে চলে তারা এবং ফলস্বরূপ নিজের অনেক ক্ষতি করে বসে।

ডিপ্রেশনের চিকিত্‍সা

এই লক্ষনগুলি যদি আপনার কোনো কাছের ব্যক্তির মধ্যে দেখতে পান তাহলে তার সাথে কথা বলুন। আশেপাশের মানুষের মধ্যে যদি এই লক্ষণ দেখতে পান তবে যত দ্রুত সম্ভব তার কাছের লোকের সাথে কথা বলুন। এইরকম ব্যক্তি যেকোনো সময় নিজেকে শেষ করে দেওয়ার মতন চরম সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তাদের কখনও একা রাখবেন না। যেভাবেই হোক বা যে মাধ্যমেই হোক তাদের সাথে কথা বলুন। তাদের সমর্থন প্রয়োজন, নিজের উপর তাদের যে বিশ্বাসটা হারিয়ে গেছে সেটা ফেরানো প্রয়োজন।

তাদের বোঝান যে তারা কতটা প্রয়োজনীয়। কখনোই ভুল করেও তাদের অবসাদকে তাদের দোষ বলে ফেলবেন না, এর ফলে অবসাদের জন্যও তারা নিজেকে দায়ী করবে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারে। তাদের ওপর রাগারাগি বা তর্ক না করে, তাদের কথা বিচার না করে শুধু শুনুন। তাদের কখনও এটা বুঝতে দেবেন না যে তাদের মানসিক পরিস্থিতির জন্য তার আপনজনেরা সমস্যায় আছেন, এতে তারা আরও প্রবল ভাবে নিজেকে দোষারোপ করতে শুরু করবে। প্রয়োজনে পেশাদার মনোবিদদের সাহায্য নিন।

আপনি নিজেই ডিপ্রেশনের শিকার হলে কি করবেন?

জীবনে অনেক মুহূর্ত আসে যখন মানুষের সামনে অনেক সমস্যা থাকলেও তার সমাধান পাওয়া যায়না। মনে রাখবেন আপনি নিজেই আপনার সমস্যার সমাধান করতে পারেন। সময় সব সমস্যাকে কাটিয়ে দেয়। খারাপ সময়ে হেরে গেলে চলবে না। নিজেকে ভালো রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করুন। যার সাথে যে পরিস্থিতিতে আপনি একটু ভালো থাকবেন সেই চেষ্টা করুন। নিজের কাছের মানুষদের সাথে আলোচনা করুন।প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের মতামত নিন।